পাহাড় রক্ষা: এক রোগের দুই ঔষধ চসিকের
পাহাড়ের মাটি ক্ষয়রোধে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ২০১৮ সালে বিন্না ঘাসের পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়। চট্টগ্রাম নগরের টাইগারপাস এলাকায় বাটালি হিল এলাকার মিঠা পাহাড়ের উত্তর পাশে চসিক এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
এবার সে একই প্রকল্পে পাহাড় রক্ষায় অজুহাতে পাহাড় কেটে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করছে চসিকের প্রকৌশল বিভাগ। এ নিয়ে বিন্না ঘাস প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা বলেন, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের কারণে বিন্না ঘাস প্রকল্পের কোন ফলাফল পাওয়া যাবে না। এতে পুরো প্রকল্পই ভেস্তে যাবে।
পাইলট প্রকল্প হিসেবে বর্তমানে বিন্না ঘাসের চাষ, পরিচর্যা, যত্ন, ফুল, ঘাসের উচ্চতা ইত্যাদি বিষয়ে ভৌত স্টাডি করা হচ্ছে। গত দুই বছরে প্রচুর চারা তৈরি করতে পাহাড়ের ঢালুতে লাগানো হয়েছে নতুন নতুন চারা।
বিন্না ঘাস প্রকল্পের মাধ্যমে পাহাড়ের মাটি ক্ষয়রোধে কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হলেও রিটেইনিং ওয়াল নির্মানের কারণে তা বাধাগ্রস্থ হবে। কারণ বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানির সাথে পাহাড়ের মাটি হয়ে এসে সেডিমেন্ট ট্যাংকে জমা হতো। যা পরে বিশ্লেষণ করে দেখা হতো যে, ট্যাংক থেকে ওভার ফ্লো হয়ে তা কত শতাংশ চলে যাচ্ছে এবং বিন্না ঘাসের শেকড় বৃদ্ধির সাথে সাথে কতটা ক্ষয় রোধ হচ্ছে। কিন্তু ওয়াল নির্মাণ করায় এতে মারাত্মকভাবে প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন চসিকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী লেফট্যানেন্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ।
বিন্না ঘাস নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি করছেন তিনি। তার পরিকল্পনাতেই তৎকালীন সময়ে থাইল্যান্ডের The Chaipattana Foundation এর সহযোগিতায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় নেয় চসিক।
লেফট্যানেন্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, রিটেইনিং ওয়ালের কোন প্রয়োজই ছিল না। যদি ওয়াল দিতে হয় তাহলে বিন্না ঘাসের কী দরকার। বর্ষার মৌসুম থেকে তারা এ ওয়াল নির্মাণ কাজ শুরু করে। যা বিন্না ঘাস প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্থ করেছে। এতে বৃষ্টির পানি প্রবাহ ও পাহাড়ের ক্ষয় রোধের তথ্য পেতে বেগ পোহাতে হচ্ছে। পিছিয়ে পড়বে পুরো প্রকল্পের কাজ।
এদিকে বিন্না ঘাস লাগানোর ফলে গত দুই বছর ধরে ভূমি ক্ষয়রোধ কমেছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের পরিচালক ও চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী বিপ্লব দাশ। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এটি ২৫ লাখ টাকার পাইলট প্রকল্প। চট্টগ্রামের পাহাড়ে ভুমি ধ্বস রোধে বিন্না ঘাস লাগাতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ২ কোটি টাকার একটি ডিপিপি পাঠানো হয়েছে।
তবে চসিকের প্রকৌশল বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, পাহাড় সুরক্ষার জন্য এ ওয়াল। জানা গেছে, ২০১৭ সালে নেয়া ৭৬০ কোটি টাকার বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তা, নালা ও প্রতিরোধ ওয়াল নির্মাণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে ৩৬ টি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ হবার কথা রয়েছে। এই প্রকল্পের অধীন লালখান বাজারের হাইলেভেল রোডের পাহাড়ে অন্য সংস্থা থেকে ওয়াল নির্মাণ করায় সেখানে নতুন করে ওয়াল নির্মাণের প্রয়োজন পড়েনি। তাই ওই প্রকল্প থেকে এই ওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে।
নিয়ম রয়েছে, ডিপিপিতে উল্লেখিত স্থানের পরিবর্তে কোন প্রকল্পের কাজ অন্যত্র করতে হলে স্টিয়ারিং কমিটির অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু কোন রকম নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ওই প্রকল্পের অর্থে পাহাড় সুরক্ষার নামে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করছে চসিক। ১৭২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২ ফুট প্রস্থের এই ওয়াল নির্মাণে ব্যায় হচ্ছে ২৫ লাখ টাকা।
প্রকল্পের পরিচালক চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড কে বলেন, জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতাধীন সাব-প্রজেক্টে ১৭২ ফুটের একটি রিটেইনিং ওয়ালের কাজ ছিল লালখান বাজারে। সেখানে নির্মাণের প্রয়োজন পড়েনি তাই বাটালী পাহাড়ের পাদদেশে বিন্না ঘাস প্রকল্পে তা করা হচ্ছে। এতে সুরক্ষিত হবে পাহাড়।
তিনি বলছেন স্টিয়ারিং কমিটির অনুমতি নিয়েই এ কাজ করা হচ্ছে। তবে এর সপক্ষে কোন নথি দেখাতে পারেননি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকা রফিকুল ইসলাম।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় শেষের দিকে নির্মাণ কাজ। ১৭২ ফুট দৈর্ঘ্যের রিটেইনিং ওয়ালে প্রতি ৩ ফুট অন্তর আরসিসি পিলার। এসব পিলারে দৃষ্টিনন্দন বৈদ্যুতিক বাতির সংযোগের জন্য ওয়্যারিংও করা হয়েছে। খাড়াভাবে ৪০ ফুট পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হচ্ছে এ রিটেইনিং ওয়াল। ৪ ফুট উচ্চতার এ ওয়াল নির্মাণ করতে পাইলিংও করা হয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে ওয়াল নির্মাণের জন্য প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ ফুট পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। নিচের দিকে কেটে ফেলায় পাহাড়ের উপরের অংশ থেকে মাটি সরে পড়ছে। সুরক্ষার নামে পাহাড় হয়ে পড়েছে এখন অরক্ষিত।
কেবল তাই নয়, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও নেয়া হয়নি কোন অনুমোদন। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ ধারা ৬ এর খ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইবে না: তবে শর্ত থাকে যে, অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণক্রমে কোনো পাহাড় বা টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক নুরুল্লাহ নুরী বলেন, নতুন করে চসিকের পাহাড় কাটার বিষয়টি আমাদের জানা নেই। এমনকি কোন অনুমতিও চায়নি আমাদের কাছে। আপনাদের কাছে থেকে জেনেছি যখন শিগগিরই আমরা ঘটনাস্থলে যাব এবং শোকজ করব।
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: Saving hill: CCC's double medicines to remedy a disease