প্রথমবারের মতো ঘুরে গেল মেট্রো রেল, উচ্ছ্বসিত মিরপুরবাসী
প্রতিদিনের মতো শুক্রবার সকালে নিজের মুদি দোকান সামলানোর কাজ করছিলেন রাজধানীর পল্লবী এলাকায় সততা স্টোরের কর্ণধার তরিকুল ইসলাম। এ সময় হঠাৎ অপরিচিত একটা শব্দ কানে আসলে তিনি হতচকিত হয়ে যান।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তরিকুল বুঝতে পারেন যে স্বপ্নের মেট্রো রেল চলে এসেছে নগরীতে। তৎক্ষণাৎ দোকান ছেড়ে এক দৌড়ে তিনি চলে আসেন পল্লবী মেট্রো রেলস্টেশনের নিচে। এর আগেই অবশ্য সেখানে জড়ো হয়েছিলেন শতাধিক উৎসুক মানুষ।
শুক্রবার সকাল ছয়টার দিয়াবাড়ির ডিপো আর কানেকটিং লাইন ছেড়ে প্রথমবারের মতো ছয় বগির মেট্রো ট্রেন উঠে মূল ভায়াডাক্টে। তবে প্রথমবারের মতো ট্রেন পরিচালনার কারণে গতি ছিল একেবারেই কম।
উত্তরা উত্তর, কেন্দ্রীয় উত্তরা ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনে যাত্রা বিরতি দিয়ে ট্রেনটি থামে চতুর্থ স্টেশন পল্লবীতে।
কোন পূর্ব ঘোষণা না থাকলেও প্রথমবারের মতো মেট্রো ট্রেন দেখতে লাইনের দুই পাশেই ছিল উৎসুক জনতার ভিড়। আশেপাশের বহুতল বাড়িগুলো থেকে এ ট্রেন দেখছিলেন অনেকেই।
জানতে চাইলে এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক এবিএম আরিফুর রহমান বলেন, "২৯ আগস্ট (রোববার) আনুষ্ঠানিকভাবে মেট্রো রেলের পারফরম্যান্স টেস্ট শুরু হবে। অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ছাড়াও শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। পারফরম্যান্স টেস্টের চূড়ান্ত প্রস্তুতির অংশ হিসেবে শুক্রবার সকালে মেট্রো ট্রেন পরিচালনা করা হয়েছে"।
তিনি জানান, সকাল ছয়টায় ট্রেনটি ডিপো ছেড়ে চলে যায়। চতুর্থ স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনটি সফলভাবে পরিচালনা করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো ট্রেনটি পরিচালনার সময় সব স্টেশনের খুঁটিনাটি দেখতে বেশি সময় লেগেছে বলেও তিনি জানান।
আগামী রোববার সকাল দশটায় মেট্রো ট্রেনের পারফরম্যান্স টেস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে বলে এর আগে জানিয়েছেন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক।
চলতি বছরের এপ্রিলে আসা প্রথম মেট্রো রেল সেটের মাধ্যমে এ পারফরম্যান্স টেস্ট পরিচালনা করা হবে। এর আগেই ডিপোর মধ্যে এ সেটের টেস্ট রান সম্পন্ন হয়েছে। আরও খুঁটিনাটি কয়েকটি পরীক্ষায় এ কোচ পরিচালনার উপযোগী মনে হয়েছে। এরই সুবাদে ডিপো ছেড়ে মেট্রো রেলের মূল লাইনে উঠানো হয়েছে ট্রেনটি।
তিনি জানান, সফলভাবে পারফরম্যান্স টেস্ট পরিচালনার পর বিভিন্ন স্টেশনে স্থাপন করা সিস্টেম পর্যালোচনা করতে ইন্টিগ্রেটেড টেস্ট পরিচালনা করা হবে। এর ফলাফলের ভিত্তিতে ট্রায়াল রানের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সব ঠিক থাকলে আগামী বছর বাণিজ্যিকভাবে মেট্রো রেল পরিচালনা করা হবে বলেও তিনি জানান।
তৃতীয় পর্যায়ে রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মেট্রো রেললাইন তৈরীর প্রকল্প নেয়া হয় ২০১২ সালে। প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ মেট্রো রেল নির্মাণে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা। পরবর্তীতে এ মেট্রো রেলের লাইন কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দেশের প্রথম মেট্রো রেলের দৈর্ঘ্য হবে ২১.২৬ কিলোমিটার।
অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা উত্তরা-আগারগাঁও পর্যন্ত লাইনের সার্বিক অগ্রগতি ৩১ জুলাই পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ৮৮.১৮ শতাংশে। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের অগ্রগতি ৬৬.৭৪ শতাংশ। সব মিলে প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি ৬৮.৪৯ শতাংশ।
সূত্র জানায়, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মোট ২৪টি ট্রেন পরিচালনা করা হবে। আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে জাপানের কাওয়াসাকি-মিতসুবিশির কারখানা থেকে ঢাকায় পৌঁছবে পঞ্চম সেট মেট্রো ট্রেন।
আনন্দিত মিরপুরবাসী
মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই রাস্তার একপাশ বন্ধ রেখে মেট্রো রেল নির্মাণের কারণে জনদুর্ভোগের এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল মিরপুর। যানজট, শব্দদূষণ আর বাতাসে ধুলাবালির কারণে মিরপুরবাসীর ভোগান্তির অপর নাম ছিল মেট্রো রেল প্রকল্প। এ প্রকল্পের কারণে প্রায় ৬৯ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আয় কমেছিল বলে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
তবে নির্মাণকাজ শেষের দিকে থাকায় ইতিমধ্যেই আগারগাঁও থেকে মিরপুর পর্যন্ত রাস্তার অনেকটাই আগের রূপে ফিরিয়ে আনায় ভোগান্তি কমেছে। এবার মেট্রো ট্রেন দেখে মিরপুরবাসীর উচ্ছ্বাস বেড়েছে।
জানতে চাইলে দোকানী তরিকুল আসলাম বলেন, "মেট্রো রেলের কাজের কারণে কয়েকমাস দোকান বন্ধ রাখতে হয়েছে। দোকান খোলা থাকলেও বেচাকেনা হয়েছে কম। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অপেক্ষায় আমরা আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ভোগান্তিও মেনে নিয়েছি। সবকিছু ছাড়িয়ে মেট্রো রেল চালু হতে যাচ্ছে জেনে খুব ভালো লাগছে"।
পল্লবী থেকে মতিঝিলের একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অফিস করেন এখলাছ হোসেন। তিনি বলেন, "সকাল নয়টায় অফিসে পৌঁছতে সাড়ে ছয়টায় রওয়ানা দিতে হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে কোথাও রাস্তা বন্ধ, কোথাও ডাইভারশনের কারণে এক ঘন্টার রাস্তা পাড়ি দিতে তিন ঘন্টা লেগেছে। নিজের নিয়মিত গন্তব্যের পথে মেট্রো ট্রেন দেখে তিনিও খুশি"।