বাংলাদেশের ইউটিউবে যেভাবে ধর্মীয় বক্তাদের প্রাধান্য বাড়ছে
এটিএম বুথের তরুণ নিরাপত্তা কর্মী মকবুল হোসেন মোবাইলে বুঁদ হয়ে ছিলেন। ইউটিউবে ওয়াজের ভিডিও দেখছিলেন তিনি।
ভিডিওর বক্তব্য কানে আসছিল। দর্শকরা জোরে সাড়া না দেওয়ার একজন বক্তা কড়া সুরে তাদের গলার আওয়াজ বাড়াতে বললেন।
"এই বেঈমানগুলারে কুত্তার মতো পিটাতে হবে। যুবকরা তোমরা কথা বলো না কেন? তোমাদের আওয়াজ এত কম শোনা যায় কেন?"- নাস্তিকদের ইঙ্গিত করে উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলছিলেন ধর্মীয় বক্তা ইলিয়াছুর রহমান জিহাদী।
ইউটিউবে সাত লাখের বেশি ফলোয়ার সমৃদ্ধ 'নাইস ওয়াজ' নামে একটি ভ্যারিফাইড চ্যানেলে 'নাস্তিকদের বিরুদ্ধে জিহাদী হুজুরের বাঘের হুঙ্কার' শিরোনামে ভিডিওটি আপলোড করা হয়।
ভিডিওটি মকবুলকে কীভাবে প্রভাবিত করলো তা বোঝা গেল না। সে বেশি কথা বলে না।
স্ক্রল করে সে অন্য বক্তাদের ভিডিও দেখতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো পরিসরে মকবুলের পক্ষে এক ভিডিওতে বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন।
সবগুলো ভিডিও যে উত্তেজনাপূর্ণ, তা নয়।
ইউটিউবে অসংখ্য ভ্যারিফাইড চ্যানেলে শত শত বক্তার এরকম হাজারো ভিডিও রয়েছে। চ্যানেলগুলোর অনুসারীর সংখ্যা লাখ লাখ। একেকটি ভিডিও প্রায় কয়েক লক্ষবারের বেশি দেখা হয়েছে।
বাংলা ওয়াজ চ্যানেলগুলোর মধ্যে অন্যতম শীর্ষ একটি চ্যানেল রোজ টিভি। প্রতিবেদনটি লেখার সময় চ্যানেলের ভিউ সংখ্যা ৯২ কোটির বেশি ছিল।
অধিকাংশ ধর্মীয় বক্তব্য বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলের আয়োজনকালে ধারণকৃত। কিছু চ্যানেল পুরো বক্তৃতার বদলে আকর্ষণীয় শিরোনাম জুড়ে দিয়ে বিষয়ভিত্তিক ছোট ভিডিও ক্লিপ তৈরি করে থাকে।
ইউটিউবে বাংলা ওয়াজ লিখে সার্চ দিলে কুরআনের বিভিন্ন বিষয়, নবী-রাসূলদের জীবনী, ইসলামী জীবনধারা সংক্রান্ত বিষয় ছাড়াও বিভিন্ন চটকদার শিরোনামের ভিডিওর দেখা মিলবে।
যেমন, গোলাম রব্বানী নামের একজন বক্তার ওয়াজের শিরোনামে লেখা 'সংসদে এমপি মমতাজের বক্তব্য নিয়ে এ কি বললেন গোলাম রব্বানী'। থাম্বনেলে বক্তা এবং সংসদ সদস্যের ছবি দেওয়া।
এই চ্যানেলগুলোর অধিকাংশের মালিকানাই তৃতীয় পক্ষের। অন্যান্য ইউটিউব চ্যানেলের মতো এখানেও দর্শকদের ক্লিকবেইটের ফাঁদে ফেলা হয়। কেবলমাত্র গুটিসংখ্যক চ্যানেল বক্তারা নিজেরা পরিচালনা করেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন ধারার এত বেশি সংখ্যক ধর্মীয় বক্তা রয়েছেন যে সমাজের ওপর তাদের প্রভাব বোঝার জন্য শ্রেণীবিন্যস্ত করা কঠিন হয়ে পড়বে।
আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ নামের একজন বক্তা বলেন, "নারীদের 'প্রযুক্তি' ব্যবহারের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। নারীদের কেবল স্বামীর সেবা এবং সন্তান জন্মদানের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।"
আরেকটি ভিডিওতে তিনি বলেন, "শয়তানের চাল দুর্বল, কিন্তু নারীদের চাল শক্তিশালী। নারীরা ভয়ঙ্কর।"
অপর এক ভিডিওতে নারী লেখক ও চিন্তাবিদ বেগম রোকেয়াকেও 'জাতির কলঙ্ক' বলে অভিহিত করেন রাজ্জাক।
বলাবাহুল্য যে এই বক্তা নারীদের নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য সমালোচিত।
রাজ্জাকের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মন্তব্য করেন আরেক বক্তা মিজানুর রহমান আজহারী। তিনি বলেন, "নারীদের ব্যবসা করার অনুমতি রয়েছে। স্বামীর অনুমতি নিয়ে তারা চাকরিও করতে পারেন।"
দুই বক্তাই বাংলাদেশে তুমুল জনপ্রিয়। প্রত্যেকের লাখ লাখ অনুসারী রয়েছে।
তাদের বক্তব্য, বলার ধরন এবং দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। কিন্তু অনুসারীরা তাদের এক কাতারে ফেলে অন্ধভাবে কোনো প্রশ্ন না করেই অনুসরণ করে যাচ্ছেন।
উদাহরণস্বরূপ, নারীদের নিয়ে বিতর্কিত ও অবমাননাকর বক্তব্য রাখায় কয়েকজন বক্তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু টিভি চ্যানেলে প্রতিবেদন প্রচারিত হয়।
প্রতিবেদনের মন্তব্যের ঘর দেখলে দেখা যাবে যে, অধিকাংশ মন্তব্যকারীই গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করছেন।
"এই টিভি চ্যানেল ধর্মীয় বক্তাদের বিরোধিতা করে। এদের বয়কট করুন," তপু রায়হান নামের একজন এ ধরনের একটি প্রতিবেদনের নিচে মন্তব্য করেছেন।
"আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশের গর্ব; তার মতো দ্বিতীয়জন খুঁজে পাবেন না। জালিমরা আলেমদের কথা বুঝতে পারবে না," বলেন তারেক হাসান।
অনুসারীদের অন্ধ ভক্তির জন্য বক্তারা বিবেচনাহীন মন্তব্য করেও পার পেয়ে যান।
তবে, বক্তারা পরস্পরের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। একজন আরেকজনের ব্যাখ্যা বা বক্তব্য নাকচ করে দেন। খুব ভালোভাবে বাংলাদেশের ওয়াজ শিল্পকে দেখলে বোঝা যাবে যে এখানকার ধর্মীয় বক্তাদের মধ্যে রয়েছে তুমুল দ্বন্দ্ব।
ধর্মীর বক্তাদের মধ্যে ভিন্ন মতধারা
জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে আপনাকে যদি বাংলাদেশের শীর্ষ পাঁচ ইসলামি বক্তার তালিকা করতে বলা হয় তাহলে সেখানে- মিজানুর রহমান আজহারী, হাফিজুর রহমান, গিয়াস উদ্দীন তাহেরী, এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী এবং আহমাদুল্লাহ'র নাম থাকবে।
কিছুদিন তাদের বক্তব্য শুনলে আপনি পার্থক্য দেখতে পাবেন।
আমরা তাদের উপস্থাপনার ভিন্নতা নিয়ে বলছি না। বরং, ইসলামকে নিয়ে তাদের বিভিন্ন ব্যাখ্যায় রয়েছে ভিন্নতা।
যেমন, ড. মোহাম্মদ মঞ্জুর-ই-এলাহী সালাফি মতধারায় অনুপ্রাণিত। আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ এবং অন্যান্য যারা আহলে হাদিসের অনুসারী, তাদের তুলনায় মঞ্জুর-ই-এলাহীর বক্তব্য খুব কড়াকড়ি বলে মনে হবে না।
এই ধারার মতাদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী তারা কেবল কুরআন এবং সহীহ হাদিসের ওপর নির্ভর করে ইসলামের ব্যখ্যা দিয়ে থাকেন। তবে, কট্টর ধারার বলে তাদের পরিচিতি রয়েছে।
বাংলাদেশের দেওবন্দি ধারার অন্যতম অনুসারী হাফিজুর রহমান। বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো মূলত ভারতের দারুল-উলম দেওবন্দের একাডেমিক কারিকুলাম অনুসরণ করে থাকে।
তালেবান এবং অন্যান্য আফগান সশস্ত্র গোষ্ঠীও দেওবন্দি ধারায় অনুপ্রাণিত। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া আলী হাসান ওসামার কথা কি মনে আছে? তিনি একজন কওমি শিক্ষক ছিলেন। ইউটিউবে তার ভিডিও খুঁজে পাওয়া যাবে। তার অসংখ্য ভিডিওতে আপনি আফগান তালেবান এবং মোল্লা ওমরের প্রশংসা শুনতে পাবেন।
বাংলাদেশে বিভিন্ন পীরদের লাখ লাখ অনুসারী রয়েছেন। অসংখ্য 'সিলসিলা' অনুসরণ করে দেশজুড়ে তারা নিজেদের মতাদর্শ অনুসারে ইসলামী শিক্ষার প্রচার করেন।
এই দলগুলো মূলত তাদেরকে হানাফি মাযহাবের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী সম্ভবত এসব দলের অন্যতম জনপ্রিয় একজন বক্তা।
এছাড়া ফুরফুরা, সারসিনা, কাদেরিয়া এবং সুফি মতধারার বহু পীর রয়েছেন বাংলাদেশে। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে ইসলামের প্রসারের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাই ছিল প্রধান।
বাড়তে থাকা বক্তাদের উপস্থিতিতে ইন্টারনেটে দেওবন্দি, কওমি, আলিয়া, সুফি, সালাফি থেকে সুন্নিসহ বিভিন্ন মতধারা অনুসারে ইসলামিক বিষয়সমূহের ভিন্ন ভিন্ন ব্যখ্যা পাওয়া যায়।
আমরা ভিন্নতার বিষয়ে এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীকে প্রশ্ন করেছিলাম। জৈনপুরের এই পীর নিজেকে হানাফি ধারার বলে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, "সালাফিরা ভিন্ন 'ফেরকা'। ওয়াহাবিদের থেকে তাদের উদ্ভব। তবে, বাংলাদেশে বিদ্যমান ইসলামিক মতধারার মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। ইসলামের মূল বিষয়গুলোর প্রসঙ্গ আসলে সবাই একই কথা বলবেন। তবে, কিছু বিষয়ের ব্যখ্যায় ছোটখাটো ও প্রাতিষ্ঠানিক পার্থক্য রয়েছে।"
তিনি বলেন, কিছু 'সেন্সরশিপে'র কারণে আগে গণমাধ্যমে ধর্মীয় বক্তাদের উপস্থিতি ছিল না। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে তারা সরাসরি দর্শকের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ পেয়েছেন।
"আমার কাছে বিষয়টি ইতিবাচক মনে হয়। কেননা, আপনি ইসলাম ব্যতীত বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সামাজিক অবকাঠামো এবং রাষ্ট্রকে মূল্যায়ন করতে পারবেন না। স্বাধীনতার মূল ধারণাই এসেছে ইসলাম থেকে," বলেন তিনি।
বক্তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ইউটিউবে বেশি প্রচার পায়
বিভিন্ন মতধারা থেকে আগত বক্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে দর্শকদের কাছে এই প্ল্যাটফর্ম আরও নাটকীয় হয়ে উঠেছে। ইউটিউব চ্যানেলগুলোর প্রচারণা বৃদ্ধিতে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
লাখো মানুষের দেখা এমন অসংখ্য ভিডিও পাওয়া যায় যেখানে একজন বক্তা একই বিষয়ে অন্য বক্তার বিরুদ্ধে কথা বলছেন।
ওয়াজগুলো শুনে তাই দর্শকশ্রোতারা একঘেয়ে বোধ করেন না।
বিতর্ক, ঠাট্টা, দ্বন্দ্ব, উত্তেজনা এবং অনেক সময় উস্কানিসহ সব মিলে বিনোদনের পরিপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠে এসব ভিডিও। ফলে, অসংখ্য মানুষকে এগুলো আকৃষ্ট করছে।
ব্যবসার প্রচুর বিনিয়োগ করার পর কয়েক বছর গেলে হয়তো টিভি বা নাটকের চ্যানেলগুলোর সামষ্টিক ভিউ ১০০ কোটি অতিক্রম করে। অথচ, টিবিএসের পর্যবেক্ষণে আসা ডজনখানেক চ্যানেলসহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ২০১৭ সালের পর যাত্রা শুরু করা এই ওয়াজের চ্যানেলগুলোতে দর্শকের সংখ্যা ঈর্ষণীয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম দ্য বিজনেস ইনসাইডারের মতে, ইউটিউবে ১০ লাখবার কোনো ভিডিও দেখা হলে আপনি অ্যালগরিদম ও ভিডিওর দৈর্ঘ্য অনুসারে তিন হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার থেকে ৪০ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত উপার্জন করতে পারেন।
তবে, কেবলমাত্র কতবার দেখা হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে চ্যানেলগুলোর আয় সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। তবে, বিজনেস ইনসাইডারের প্রতিবেদন থেকে 'ন্যূনতম' ধারণা লাভ করা সম্ভব।
রোজ টিভির ভিউয়ারশিপ বিবেচনা করে ৯০ কোটি ভিউয়ারশিপের সাথে তিন হাজার ৪০০ ডলার গুণ করলে হয় ৩০ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। যা প্রায় ২৫ কোটি টাকার সমতুল্য।
তবে, অন্যান্য সূত্রানুসারে, ইউটিউবাররা প্রতি এক হাজার ভিউয়ের জন্য এক ডলার করে পান। সেক্ষেত্রে, সংখ্যাটি রাতারাতি পরিবর্তিত হবে। তা সত্ত্বেও, মোট টাকার অঙ্কটি বিশাল।
আমরা এক কোটি থেকে ৯০ কোটির বেশিবার দেখা অন্তত ২০টি চ্যানেলের সন্ধান পেয়েছি।
এসব চ্যানেলের অধিকাংশই ধর্মীয় বক্তাদের মালিকানাধীন নয়। কিন্তু, এই বক্তারা কি এসব ভিডিও প্রকাশের পরিবর্তে কোনো সম্মানী পেয়ে থাকেন?
বিষয়টি বের করে আনা কঠিন। কেননা, ধর্মীয় বক্তারা ওয়াজ থেকে তাদের আয়ের হিসাব বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।
বক্তারা তাদের আয়ের প্রসঙ্গে নীরব
আমরা গিয়াস উদ্দীন তাহেরীর সঙ্গে কথা বলি। জনপ্রিয় এই বক্তার অনেক বক্তব্যই ইউটিউবাররা ডিজে গানে ডাব করে ব্যবহার করেন।
ওয়াজের মৌসুমে তিনি কত টাকা উপার্জন করেন সে বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি অস্বস্তিবোধ করেন। তবে, তিনি জানান, ওয়াজের মৌসুমে (সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস) তিনি দৈনিক অন্তত তিনটি মাহফিলে অংশ নেন।
আমাদের কাছে সম্মানীর বিষয়ে বলতে সংকোচ বোধ করলেও ইউটিউবে আগে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে, প্রতি মাহফিলের জন্য তিনি এক লাখ করে টাকা পেয়ে থাকেন।
পুরো এক মৌসুমে তাহেরীর আয়ের পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ হিসাব বের করা কঠিন। পাশাপাশি বিভিন্ন মাহফিলে সম্মানীর অর্থ ভিন্ন হয়ে থাকে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ধর্মীয় বক্তাদের আয় খোলাসা না করার প্রবণতাই বেশি। আমরা অনেককেই ওয়াজ থেকে তাদের আয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু, তারা সে সম্পর্কে কিছুই জানাতে রাজি হননি।
অনলাইন বক্তাদের সামাজিক প্রভাব
অনলাইনে ধর্মীয় বক্তাদের স্বতস্ফূর্ত উপস্থিতি সম্পর্কে আমরা সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষকদের মূল্যায়ন জানতে চেয়েছিলাম।
"সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত প্রতিলিপি নির্মাণের প্রবণতা, তাৎক্ষণিক সাড়াদান ও প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগিয়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠার ক্ষমতা এবং বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্কে প্রবেশের সহজ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ইসলামী বক্তারা বাংলাদেশের সাইবার স্পেসে প্রভাববিস্তারকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন," বলেন জার্মানির বনভিত্তিক ডিজিটাল মিডিয়া এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাইমুম পারভেজ।
"বর্তমানে ইসলামী বক্তারা মূলধারার প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরতা ছাড়াই নিজেদের কনটেন্ট তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কনটেন্ট তৈরি করার নিয়ন্ত্রণ থাকায় তারা নিজেদের বক্তব্য প্রায় কোনো ধরনের খরচ ছাড়াই লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন," বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধাপক সাদেকা হালিম বলেন, অনেক বক্তা তাদের বক্তৃতায় নারীদের সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন। তারা নারীর মন এবং শরীরের নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন। দেশের অন্যান্য ধর্মপ্রাণ মানুষদেরও কটাক্ষ করে মন্তব্য করেন তারা। সমাজে বিষয়গুলোর দীর্ঘকালীন প্রভাব আছে বলে জানান সাদেকা হালিম।
ওয়াজের নামে ইসলামী বক্তারা যা বলছেন, তা সরকারের নজরদারির আওতায় আনা উচিত বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে, সাইমুম পারভেজ অনলাইনে ইসলামী বক্তাদের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পান। তিনি বলেন, "আমাদের ঢালাওভাবে তাদেরকে নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করা উচিত নয়। পৃথকভাবে প্রতিটি কেস বিশ্লেষণ করতে হবে। সহিংসতা বা জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে এ ধরনের ওয়াজগুলো হুমকিস্বরূপ। তবে, নির্বিচারে সকল ইসলামী বক্তাকে সমাজের জন্য নেতিবাচক ভাবলে তা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।"
নাস্তিক এবং নারীদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্যের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী বলেন, "অনেক বক্তাই কিছু বিষয় ব্যখ্যা করতে গিয়ে প্রবক্তা হয়ে উঠেন। ইসলাম তাদের বক্তব্যের দায়ভার নিবে না। কিন্তু জ্ঞানসম্পন্ন ইসলামী স্কলারদের উপস্থিতি থাকায় তারা ক্ষতিসাধনের সুযোগ পাবেন না।"
নিরাপত্তা পর্যবেক্ষকরা অনলাইনে ধর্মীয় বক্তাদের উপস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন?
অতীতে বিভিন্ন আইন লঙ্ঘন করে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগে বেশ কয়েকজন বক্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নামে অবমাননাকর বক্তব্য রাখার অভিযোগে শিশুবক্তা হিসেবে পরিচিত রফিকুল ইসলাম মাদানিকে আটক করা হয়। মজার বিষয় হলো, তিনি কারাগারে আটক থাকলেও তার বক্তৃতাগুলো এখনও অনলাইনে পাওয়া যায়। সেসব ভিডিওর দর্শকসংখ্যাও বাড়ছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বলেন, দেশে কয়েক হাজার ধর্মীয় বক্তা রয়েছেন। তারা কী বলছেন তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়।
পুলিশের অ্যান্টি-টেররিজম বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, "অনলাইনে কনটেন্ট মনিটর করার মতো আমাদের যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া, আমরা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চসহ গোয়েন্দা বিভাগ ও ইউনিটের সহায়তায় অফলাইন মাহফিলের বক্তৃতাও পর্যবেক্ষণ করে থাকি।"
"তাদের ওয়াজে অনেক সময় রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়, যার ফলে দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। আর তাই, কয়েকজন বক্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে", বলেন তিনি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রধানমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন জাতীয় আইকনকে আক্রমণ করে বক্তাদের আইন ভঙ্গের বেশ কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরে।
অ্যান্টি টেরোরিজম বিভাগের প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কামরুল আহসান বলেন, "তারা শিক্ষিত মানুষ এবং তারা জানেন বক্তৃতায় কী বলা যায় এবং কী বলা যায় না। তারা যদি এমন কিছু বলে থাকেন, যা আইনের বিরুদ্ধে যায়, তখন আমরা আইনানুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।" তবে, আমাদের উল্লেখিত উদাহরণগুলোর বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নিরাপত্তা এবং সামাজিক বিষয়গুলোকে আলাদা রাখলে স্বীকার করুন বা না করুন, বাংলাদেশের ইউটিউবে এখন ধর্মীয় বক্তারাই সবথেকে বড় তারকা।
মনে আছে, কয়েক দিনের মধ্যে কীভাবে মিজানুর রহমান আজহারির ইউটিউব চ্যানেল কোনো ভিডিও প্রকাশের আগেই ১০ লাখ সাবস্ক্রাইবার সংগ্রহ করেছিল?
মেয়েদের ওয়াজের সাথে টিকটক ভিডিও বানাতে দেখেছেন?
এর বাইরে, ওয়াজের পর্যালোচনা উপস্থাপন করেও অনেক ইউটিউবার লাখ লাখ ভিউ সংগ্রহ করছেন।
টেক ভয়েজ বিডি নামের একটি প্রযুক্তিনির্ভর চ্যানেলে প্রযুক্তির পরিবর্তে ওয়াজের পর্যালোচনা করা হয়। বাংলাদেশের শীর্ষ ইউটিউবার সালমান মুক্তাদিরের ইউটিউব চ্যানেল 'সালমান দ্য ব্রাউন ফিশে'র চেয়েও চ্যানেলটির ভিউ অনেক বেশি।
স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ধরনের পরিবর্তন আসছে। বিষয়টি আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না।
তবে, অনলাইনে ধর্মীয় বক্তাদের এই সরব উপস্থিতি সমাজ এবং দেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
তবে, দর্শকশ্রোতা শিক্ষিত হোক বা নিরক্ষর, স্বীকার করতে হবে যে, ওয়াজ দেখা বাংলাদেশের নতুন ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে।