বাসা-অফিস বদলের হার কম, ব্যবসা নেমেছে অর্ধেকে
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর সাধারণ ছুটি শেষে ব্যয় সংকোচনের কারণে বাসা-অফিস বদলের হিড়িক পড়লেও পিক সিজনে এসে এই খাতের ব্যবসা অন্যান্য বছরের স্বাভাবিকের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগামী মৌসুম ছাড়া তাদের এই ব্যবসা স্বাভাবিকে ফিরবে না।
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধে দেশে ২০২০ সালের ২৬শে মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। আর একই বছরের ৩০ মে তে এই ছুটি শেষ হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাধারন ছুটি শেষ হওয়ার পর জুন-জুলাই-আগস্ট এই তিন মাস তাদের ব্যবসা বেশ ভালো ছিল।
তারা জানান, সাধারন ছুটি শেষ হওয়ার পরপরই কোভিড সংকটে পড়ে সে সময় অনেক মানুষ চাকুরি হারিয়েছে। কেউ আবার বেতনের অর্ধেক পেয়েছে। সে সময় মানুষ আসলে বুঝতে পারছিল না, পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরতে পারে। তাই সে সময় অনেকেই ঢাকা ত্যাগ করেছেন, কেউ আবার ঢাকার মধ্যেই কম ভাড়ার বাসা-অফিস বদল করেছেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। তাই সাধারণত বছরের এই সময়ে এসে যারা বাসা বদল করতেন, তারা এবার করছেন না। আর যারা ঢাকার ও এর বাইরে বাসা-অফিস বদল করেছেন, তাদেরও আগের অবস্থানে ফেরার হার কম।
বাসা-অফিস বদলের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা সারা বছর কম-বেশি ব্যস্ত থাকলেও ডিসেম্বর থেকে মার্চ- এই সময়টাকে তারা তাদের ব্যবসার পিক সিজন হিসেবে ধরে থাকেন।
ঢাকায় গত এক দশকে বাসা-অফিস বদলের ব্যবসার খাতে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য-প্যাক অ্যান্ড শিফট, সেবা এক্সওয়াইজেড, মুভ অ্যান্ড সেটেল, বেঙ্গল মুভার্স, রাজধানী মুভার্স, দরকারি ডট কম, ঢাকা মুভার্স.কম, ট্রাক লাগবে, এডভ্যান্স মুভার্স, দ্যাটকুইক ও গৃহ.কম।
এদিকে বাসা-অফিস বদল ব্যবসা খাতে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানের বাইরে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। এরা মূলত এলাকাভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে।
কতটা কমেছে বাসা-অফিস বদল?
বেঙ্গল মুভার্সের কর্ণধার রেদওয়ান হোসাইন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এবার পিক সিজনে বাসা-অফিস বদলের হার ৫০-৫৫ শতাংশ কমেছে। তাই এখন মাসের একটা সময় বসে থাকতে হচ্ছে'।
কোভিড সংকটে বাসা-অফিস বদলের সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউ কেউ তাদের কর্মী ছাটাই করেছে। মুভ অ্যান্ড সেটেলের কর্ণধার শয়ন চন্দ্র বর্মন বলেন, 'কোভিড সংকট ও পিক সিজনে ব্যবসা খারাপ হওয়ার কারণে আমি আমার অফিসের ৩ জন কর্মী ছাটাই করতে বাধ্য হয়েছি'।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু ঢাকাতেই প্রতি বছর তিন থেকে চার লাখের মত মানুষ বাসা-অফিস বদল করে। আর ২০১৯ সালের সঙ্গে তারা যদি ২০২০ সালের তুলনা করেন, তাহলে এই খাতে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এদিকে 'সেবা এক্সওয়াইজেড' এর কো ফাউন্ডার অ্যান্ড চিফ অপারেশনস অফিসার ইলমুল হক সজীব টিবিএসকে বলেন, 'সবমিলিয়ে শুধু ঢাকাতেই এই খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দশ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর মানুষজন বাসা-অফিস বদলের বিষয়ে আগের তুলনায় এখন আরও বেশি সচেতন হয়েছে। যার কারণে পেশাদারিত্বের সঙ্গে বাসা-অফিস বদলের ব্যবসায় জড়িত থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো জনপ্রিয় হয়েছে'।
কম ভাড়ায় ঝুঁকেছে মানুষ
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পরপরই ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী ও উত্তরা থেকে বাসা-অফিস বদল করে অনেকেই কাঁঠালবাগান, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বসিলা, ঢাকা উদ্যান, আটিবাজার ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় শিফট করেছেন।
রুহুল আমিন, ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকুরি করেন। মোটা অংকের স্যালারি পেতেন। কিন্তু কোভিড সংকটে পড়ে তার বেতন অর্ধেক হয়ে যায়। তিনি বনানী থেকে বাসা বদল করে এখন মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকছেন। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'বাধ্য হয়েই বাসা বদল করেছি। সংকট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। পরিস্থিতি সামাল দিতে পারলে আবার ওই এলাকায় ফিরে যাব'।
ঢাকায় ফেরার হার অর্ধেকেরও কম
এদিকে সাধারণ ছুটি শেষে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটিয়ারা বাসা ছেড়ে দিয়ে কুড়িগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, কুষ্টিয়া, লালমনিরহাট ও খুলনা এলাকাতে বেশি গিয়েছেন।
বাসা বদলের ব্যবসায় জড়িত ব্যবসায়ীরা টিবিএসকে বলছেন, যারা কোভিড সংকটে ঢাকা ছেড়েছেন তার মধ্য থেকে দশ শতাংশের হিসেবে ৩ শতাংশ মানুষ আবার ঢাকা ফিরেছেন।
রাজধানী মুভার্সের কর্ণধার হাসিবুল আলম জিয়া টিবিএসকে জানান, তার প্রতিষ্ঠান লকডাউন শেষে ঢাকার বাইরে প্রায় ১৫০টি পরিবারকে শিফট করে দিয়েছে। সম্প্রতি তাদের অনেকেই ঢাকায় ফিরছেন। তবে সেই সংখ্যাটা অর্ধেকেরও কম। তার ধারণা বাকিদের ঢাকায় ফিরতে আরও বছরখানেক সময় লাগবে।
তিনি বলেন, 'তবে যারা ঢাকার ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী ও উত্তরা থেকে বাসা-অফিস বদল করে আরেকটু কম খরচের এলাকার দিয়ে গিয়ে বাসা-অফিস নিয়েছিলেন, তাদের আগের অবস্থানে ফেরার হারের কথা যদি বলি-সেখানে দশ শতাংশের মধ্যে তিন শতাংশের মত মানুষ আবার আগের অবস্থানে ফিরেছে'।
প্রতিযোগিতা বাড়ছে
এদিকে ঢাকা শহরে বাসা-অফিস বদলের ব্যবসায় জড়িত যে ক'টি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে, তারমধ্যে একটি প্যাক অ্যান্ড শিফট। গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠানটি এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
প্রতিষ্ঠানটি সাবেক রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্রদূত, সচিব, কবি, সাহিত্যিকসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষের বাসা-অফিস বদল করেছে। প্রতিষ্ঠানটি শুধু ঢাকা নয় আন্তর্জাতিকভাবেও ব্যবসা পরিচালনা করছে। এর সিইও মোহাম্মদ কাওসার আলম খসরু টিবিএসকে জানান, গত এক দশকে এই খাতে প্রতিযোগিতা দুই-তিন গুণ বেড়েছে।
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ এখনো প্রফেশনাল মুভিং কোম্পানিগুলোর কথা এখনো জানেন না। তবে মানুষ আস্তে আস্তে জানতে শুরু করেছে। দিন দিন প্রফেশনাল কোম্পানিগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে, সেবাগ্রহীতার সংখ্যাটাও বাড়ছে'।
ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ব্যবসা করছেন অনেকে
এদিকে ঢাকায় বাসা-অফিস বদলের জন্য পেশাদারিত্বের সঙ্গে দশটির মত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও রাজধানীতে এলাকাভিত্তিক ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেকে এই ব্যবসা করে থাকেন। এই খাতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে বলে মনে করেন এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা।
মিরপুরের এমনই একজন সাইফুল ইসলাম। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আমার দুটি চায়ের দোকান রয়েছে। পাশাপাশি ৫টি ভ্যান গাড়ি রয়েছে। আমি প্রথমে ভ্যানের মাধ্যমে বাসা-অফিস বদল করতাম। ব্যবসা ভালো হতে থাকায় আমি বছর দুই আগে একটি ছোট পিকআপ ভ্যান কিনেছি। ব্যবসা খারাপ নয়'।
জিনিসপত্র ভাঙা, চুরি ও ক্ষতিপূরণ
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শিফটিংয়ের সময় সাধারনত কাঁচের তৈরি জিনিসপত্র ভেঙে যাওয়ার অভিযোগ পান তারা। এমন ঘটনা ঘটলে তারা আলোচনার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সেই জিনিসপত্রের অর্ধেক দাম দিয়ে থাকেন।
তবে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির সূত্রগুলো দাবি করেছে, তাদের কাছে এখন পর্যন্ত কেউ চুরির অভিযোগ করেনি।
সেবা প্ল্যাটফর্মের চিফ অপারেশনস অফিসার ইলমুল হক সজীব টিবিএসকে জানান, সম্প্রতি তাদের এক ক্লায়েন্টের বাসা বদলের সময় অসতর্কতাবসত একটি টিভি ভেঙে গিয়েছিল। পরে তারা তাদেরকে একটি নতুন টিভি কিনে দিয়েছিলেন। তবে যদি কোনো ক্ষতির ঘটনা সত্যিকার অর্থেই ঘটে, তখন তারা সঠিক তদন্ত শেষে সর্বোচ্চ দশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করে থাকে।
আবার প্যাক অ্যান্ড শিফট জানায়, সম্প্রতি তাদের এক ক্লায়েন্ট মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুর বাসা শিফট করেছেন। সে সময় তাদের টিভি হারানো গিয়েছে। এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের এক লাখ বিশ হাজার টাকা দিয়েছেন তারা।