বিটিসিএল: এক সাম্রাজ্যের পতন
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মো. আবদুল জলিল। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) এ ল্যান্ডলাইন সংযোগের জন্য আবেদন করেছিলেন। সমস্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকলেও বিটিসিএল এর কর্মকর্তাদের গড়িমসির কারণে বাড়িতে সংযোগ পাচ্ছিলেন না তিনি। এই দেরির কারণে শেষ পর্যন্ত মন্ত্রীর শরণাপন্ন হতে বাধ্য হলেন তিনি।
আবদুল জলিলের মতো বিটিসিএল এর কাছ থেকে সংযোগ প্রার্থী সবাইকেই এই ভোগান্তি পোহাতে হয়।
এছাড়াও, সংযোগের অব্যবস্থাপনা, ক্রমবর্ধমান কর আর বিলের চাপে ব্যবহারকারীরা সংযোগ ছেড়ে দিচ্ছেন।
ঠিক একই রকম করে অব্যবস্থাপনা আর ভৌতিক বিলের চাপে শেষ পর্যন্ত ২০ বছরের পুরনো সংযোগ ছেড়ে দিয়েছেন উত্তরার বাসিন্দা আসিফ আবদুল্লাহ।
আসিফের মত হাজার হাজার ল্যান্ডলাইন ব্যবহারকারীই বাধ্য হয়েছেন সংযোগ ছেড়ে দিতে। এভাবেই ধীরে ধীরে এককালের অভিজাত এই যোগাযোগের অনুষঙ্গটি হারিয়ে যাচ্ছে।
গত ছয় বছরে ৪ লাখ গ্রাহক হারিয়েছে বাংলাদেশ টেলি কমিউনিকেশন লিমিটেড (বিটিসিএল)।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, সংযোগ ফি কমিয়ে দেয়ার পরও এই সংখ্যা কমেছে।
বিটিসিএল সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকায় একটি নতুন টেলিফোন সংযোগ নিতে খরচ হয় ২ হাজার টাকা, চট্টগ্রামে ১ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা, উপজেলা এবং বিভাগে খরচ হয় ৬০০ টাকা করে।
১৯৯০ এর দশকে চিত্রটা এমন ছিল না। তখন নতুন টেলিফোন সংযোগের জন্য খরচ করতে হতো ২০ হাজার টাকা। ২০০৪ সালে এই ফি কিছুটা কমে এসে ১৬ হাজার টাকায় দাঁড়ায়।
২০১৩ সালে দেশ জুড়ে ল্যান্ডলাইন সংযোগ ছিল ১০ লাখ। এখন সেই সংখ্যা কমে ৬ লাখে দাঁড়িয়েছে।
দেশে ল্যান্ড লাইনের একমাত্র সংযোগদাতা হিসেবে বিটিসিএল এর সর্বোচ্চ ১৪ লাখ সংযোগ সেবা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে।
বিটিসিএল বলছে, প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে বাজারে এখন স্বল্প খরচে, সহজে মোবাইল কিনতে পাওয়া যায়। একারণে তাদের সংযোগ সংখ্যা কমছে, সেবার মান খারাপ বা সুব্যবস্থাপনা নেই, ব্যাপারটা সেরকম নয়।
বিটিসিএল এর কোম্পানি সেক্রেটারি মো. আনোয়ার হোসেন মাসুদ বলেন, "বিশ্বজুড়ে মোবাইল ফোনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় সবখানেই ল্যান্ড ফোনের ব্যবহার কমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মোবাইলে আরও অনেক বেশি অপশন, সুবিধা পাওয়া যায়। আর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে যেখানে সেখানে চলাচল করা যায়। এসমস্ত কারণেই সাধারণ মানুষ ল্যান্ডফোনের চাইতে মোবাইল ফোনকেই বেশি পছন্দ করে।"
যদিও ব্যবহারকারীদের অনেকেই বলছেন বাজে সেবা, লাইনম্যানদের অপেশাদার আচরণ এবং ভুতুড়ে বিল - এসমস্ত কারণেই বিটিসিএল এর ল্যান্ডলাইন সংযোগ ছেড়ে দিয়েছেন তারা।
আসিফ আবদুল্লাহ নামে একজন ব্যবহারকারী জানান, প্রতিবার ঈদের আগে তাদের ল্যান্ডফোনের লাইন কেটে যেত, আর এতে মন খারাপ যেমন হয়ে যেত আবার নতুন করে সংযোগ নিতে খরচ হতো টাকা-পয়সাও।
ব্যবহারকারীদের এমন কথার সুর ধরেই বললেন কয়েকজন টেলিকম বিশেষজ্ঞ। বিটিসিএল এর মানহীন সেবাই যে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী স্বীকার করলেন তারা। যদিও মোবাইল ফোনের সর্বজনীন ব্যবহারও এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে দাবি করেন তারা।
টেলিকম বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবের দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ল্যান্ডলাইনের বিপরীতে আরও অসংখ্য সুবিধাজনক অপশন আছে মানুষের। ফলে এর চাহিদা আর আবেদনও কমে গেছে মানুষের কাছে। এছাড়াও প্রায়ই সংযোগের তার চুরি হয়ে যায়, এতে যোগাযোগ বন্ধ যায় হঠাৎ করে, মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকে না। আর এটা ব্যবহারকারীদের জন্যও বেশ অসুবিধাজনক, কেননা বারাবার সংযোগের তার কিনতে হয়, মেইনটেনেন্স এর জন্য খরচ করতে হয়।"
ক্ষতি হচ্ছে গত এক দশক ধরে
২০০৮ সালে স্বায়ত্তশাসিত হবার পর প্রথম কয়েক বছর যা কিছু লাভ করতে পেরেছিল বিটিসিএল কিন্তু এরপর আর লাভের মুখ দেখে নি রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটি।
দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিকম ও ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান গত এক দশকে গুণে মানে ও ব্যবসায়ে উন্নতি করেছে। অথচ সব রকমের অবকাঠামো ও নীতিগত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও উন্নতির বিপরীতে উল্টো অবনমনের দিকে গেছে প্রতিষ্ঠানটি।
দেশের ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী ১৩৩ প্রতিষ্ঠানের একটি অগ্নি সিস্টেম লিমিটেড। ২০১০-১১ অর্থবছরে কোম্পানিটির লাভ হয়েছে ৪.১৭ কোটি টাকার। এর পরের বছর লাভের এই ধারা অব্যাহতি রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির লাভ হয় ৬.৯৫ কোটি টাকার।
২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে প্রতিষ্ঠানটির লাভের খাতায় ৬ কোটির নিচে নামে নি।
অন্যদিকে, দেশের আন্তর্জাতিক গেটওয়ে সেবা প্রদানকারী ২৪ টি প্রতিষ্ঠানের একটি মীর টেলিকম লিমিটেড। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক ফোন কল থেকে ৪১.৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
অথচ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল ভয়েস ক্যারিয়ার সার্ভিস, আন্তর্জাতিক গেটওয়ে সেবা, ইন্টারনেট সেবা প্রদান, ল্যান্ড ফোন অপারেটর এমনকি ওয়েবসাইটের ডোমেইন নিবন্ধন সুবিধাও দেয়। দেশব্যাপী অবকাঠামো এবং সংযোগ আছে প্রতিষ্ঠানটির।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশ জুড়ে ৩৯ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকার সম্পত্তি প্রতিষ্ঠানটির।
এরপরও একের পর এক ক্ষতি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির। গত ১০ বছরে কেবল একবার মাত্র লাভের মুখ দেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিটিসিল কর্তৃপক্ষ মনে করে ইন্টারনেট সেবার বিক্রি কম বলে প্রতিষ্ঠানটি লাভ করতে পারছে না।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কোম্পানি কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার অভাব এবং আধুনিক সেবা প্রদানের অভাব বিটিসিএল এর ক্ষতির মূল কারণ।
সাম্প্রতিক উদ্যোগ
হারানো গৌরব ফিরে পেতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বিটিসিএল।
টেলিকমিউনিকেশন মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার গত ২২ অক্টোবর ঘোষণা দেন, সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ল্যান্ড লাইন সেবা দেবে বিটিসিএল।
২০২০ সাল জুড়েই এই সেবা দেবে প্রতিষ্ঠানটি।
এর আগে ৮ আগস্টে ল্যান্ড লাইন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটি মাসিক ১৫০ টাকা ফি এর বিনিময়ে আনলিমিটেড টক-টাইম সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দেয়।
এছাড়াও ১৬ আগস্ট থেকে অন্য অপারেটরে মিনিট প্রতি ৫২ পয়সা চার্জের বিনিময়ে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়াও নতুন সংযোগের জন্য ডিমান্ড নোটের পরিবর্তন, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কাস্টমার সার্ভিস প্রদান সহ আধুনিক বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে বিটিসিএল।