বিদেশি ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ বাতিলে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে শ্রমিকদের
বিশ্বমারীর অজুহাতে শত শত কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে আন্তর্জাতিক ক্রেতা ব্রান্ডগুলো। মহামারির প্রথম থেকেই এই প্রবণতা চলমান। ফলে সরবরাহ চক্রের সবচেয়ে নিচে থাকা গরীব শ্রমিকেরা পড়েছেন সীমাহীন দুর্দশায়।
কারখানা বন্ধ হওয়ায় তাদের অনেকেরই এখন কর্মসংস্থান নেই। মজুরিও কমেছে। পরিবার নিয়ে তাই তাদের দিন কাটে অনাহারে-অর্ধাহারে।
সাম্প্রতিক এক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে এমন দুর্দশার চিত্রই তুলে ধরা হয়।
জরিপ প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, লেসোথো, হাইতি, ইথিওপিয়া, এল সালভেদর এবং কম্বোডিয়া এই নয়টি দেশের প্রায় ৪শ' পোশাক শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রস্তুত করে শ্রম অধিকার গোষ্ঠী ওয়ার্কার রাইটস কনসোর্টিয়াম- ডব্লিউআরসি।
ডব্লিউআরসি'কে সাক্ষাৎকার দেওয়া শ্রমিকদের ৮০ শতাংশ প্রায়শ'ই অনাহারে থাকার কথা জানিয়েছেন। আর সমীক্ষায় অংশ নেওয়া এক-চতুর্থাংশ জানান দৈনিক খাদ্য সঙ্কটের কথা। অথচ, তাদের অক্লান্ত শ্রম থেকেই বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে পৃথিবীর বিখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো।
সমীক্ষায় অংশ নেওয়াদের ৬০ শতাংশই রপ্তানি কেন্দ্রিক কারখানার কর্মী। চাকরি থাকা অবস্থাতেই তাদের এমন শোচনীয় হাল। মহামারিতে আয় কমা এবং খাদ্যপণ্যের দর স্থানীয় বাজারে বৃদ্ধিও যার আরেক কারণ।
ডব্লিউআরসি জানায়, আলোচিত নয়টি দেশেই চলতি বছরের শুরু থেকে গার্মেন্টস কর্মীদের আয় গড়ে ২১ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ফলে তারা মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেও হিমশিম খাচ্ছে।
যাদের চাকরি নেই, তাদের হাল আরো শোচনীয়। কারখানা বন্ধ হওয়ার যেমন অনেকের চাকরি গেছে, আবার বিদেশি ক্রেতাদের পাওনা পরিশোধে অনীহার কারণেও চাকরীচ্যুত হয়েছেন অসংখ্য শ্রমিক। অনেক ক্রেতা ব্র্যান্ড আবার লোকসানের কথা বলে তাদের ব্যবসা বন্ধ করেছে।
সম্প্রতি ব্রিটিশ রিটেইল ব্র্যান্ড ডেবেনহামস তাদের সকল আউটলেট বন্ধের ঘোষণা দেয়। অথচ প্রতিষ্ঠানটির কাছে ৫ কোটি ডলারের বেশি পাওনা রয়েছে বাংলাদেশী সরবরাহকারকদের। এই অর্থ পরিশোধের কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি যুক্তরাজ্যের ঐতিহ্যবাহী ব্র্যান্ডটি।
সব মিলিয়ে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশের কারখানা মালিক এবং শ্রমিকেরা এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। তবে ভোগান্তির যেন শেষ নেই অসহায় শ্রমিকদের।
এব্যাপারে ডব্লিউআরসি'র কৌশলগত গবেষণা পরিচালক পেনেলোপ ক্রিটসিস বলেন, 'শ্রমিকদের দূর্দশা লাঘবে অবশ্যই ব্র্যান্ডগুলোর অনেকখানি দায় রয়েছে।'
তার মতে, ''ফ্যাশন শিল্প তার ভিনদেশি কর্মীদের দীর্ঘমেয়াদী কম মজুরি দিয়ে এই সংকটের মধ্যে অতিমাত্রায় ঝুঁকিতে ফেলেছে। তাছাড়া কর্মীদের জীবিকা বিপন্ন হয়েছে এবং তারা মহামারির অর্থনৈতিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতা হারিয়েছেন। আর সঙ্কটের মুখে শিল্পটি যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা পরিস্থিতিকে আরো শোচনীয় করে তোলে। এই মুহূর্তে যদি কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে আমরা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত এ শিল্পের সরবরাহ চক্রে চরম মানবিক বিপর্যয় লক্ষ্য করবো।''
কম্বোডিয়ার এক গার্মেন্টস কর্মী দ্য গার্ডিয়ানকে জানান, গত এপ্রিলে ব্র্যান্ডগুলো ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া এবং অর্ডার বাতিলের পর তিনি যে কারখানায় কাজ করতেন- সেটি বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় বকেয়া বেতন প্রায় দেড় হাজার ডলার তাকে পরিশোধ করা হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই ঋণ নিয়ে কোনো রকমে জীবন–ধারণ করছেন। ঋণের অর্থে দিনে একবেলা খাবার খান, যাতে তার তিন বছর বয়সী শিশুটিকে অন্তত বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন।
''কারখানা যতদিন সচল ছিল তখন মোটামুটি স্বচ্ছন্দে চলতে পারতাম। কিন্তু, হঠাৎ করেই যখন বন্ধ হলো, তখন আমার কাছে কোনো সঞ্চয় ছিল না। এখন আমি আর আমার স্বামী দিনে একবেলা শুধু ভাত খাই। মেয়ের কথা ভেবেই ধারকর্য করে হলেও প্রতিদিন অন্তত ভাতটুকু খেতে হচ্ছে। কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে আমার পাওনা টাকা কীভাবে তাদের দিতে বাধ্য করব, সেই উপায় আমার জানা নেই,'' শ্রমিকটি এভাবেই নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরেন।
সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে মহামারির প্রথম থেকেই ঋণ করার কথা জানিয়েছেন সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৭৫ শতাংশ শ্রমিক।
ইন্দোনেশিয়ার এক গার্মেন্টস কর্মী জানান, অর্ডার বাতিলের কারণে গত সেপ্টেম্বরে তার চাকরিদাতা কারখানাটি দেওলিয়া হয়ে পড়ে। এখন তিনি প্রতিবেশীদের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর টিকে আছেন। যে অর্থ ধার করেছেন তার একটি পয়সাও শোধ করতে পারেননি।
''আমার এলাকায় গার্মেন্টস কারখানা ছাড়া আয়ের কোনো উৎস নেই। আমার বয়স এখন ৪০, তাই অন্যান্য যেখানেই কাজের জন্য গেছি সবাই বয়স বেশি বলে তাডিয়ে দেয়। ধারের অর্থ ফেরত দেব কেমন করে, সেই চিন্তায় দিনরাত অস্থির থাকি,'' চিন্তিত মুখে তিনি বলছিলেন।
এব্যাপারে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের সহ-লেখক এবং শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিভাগের অধ্যাপক জেনেভিভ লে'ব্যারন জানান, গবেষণায় দরিদ্র এসব কর্মীর ঋণের মাত্রা বেড়ে চলাকে সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব হিসাবে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়।
তিনি বলেন, ''প্রায় ৭৫ শতাংশ শ্রমিক আমাদের খাদ্য ক্রয়ের জন্য ঋণ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। এদের মধ্যে অর্ধেকই মহামারির আগে যে কারখানায় কাজ করতেন, এখনও সেখানেই চাকরি করছেন। তার মানে দাঁড়ায়; তাদের চাকরি বেঁচে গেলেও, আয়ের পরিমাণ কমেছে। ফলে সেই ঘাটতি মেটাতে তারা ধারকর্য করে চলছেন।''
লে'ব্যারন আরো বলেন, ''আলোচিত নয় দেশের শ্রমিকদের আয় ও দক্ষতায় কমবেশি পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা সকলেই একই ধরনের সমস্যা কবলিত হয়েছেন, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই শিল্পের অন্যায্য ব্যবস্থায় সবচেয়ে নিচে থাকা শ্রমিকদের ঘাড়েই সব বিপদের ঝুঁকি চাপানো হয়। তাদেরকেই ধনী কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় মন্দার মূল্য দিতে হচ্ছে।''
চলতি বছরের শুরু থেকে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো আনুমানিক প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল করে।
সহজেই তারা এমনটা করতে পেরেছে, কারণ; আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো প্রতিযোগীতামূলক নিম্নদরে তাদের কার্যাদেশ উন্নয়নশীল দেশের সরবরাহকারীদের দেয়। চুক্তিপত্রেও থাকে অন্যায্য শর্ত। অধিকাংশ সময়েই পণ্য গন্তব্য পৌঁছানোর কয়েক মাস পর অর্থ পরিশোধ করা হয়।
এইসব সুবিধা নিয়েই তারা এখন আগে অর্ডার দেওয়া অনেক পণ্যের চালান গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। বাতিল করেছে চলমান ক্রয় চাহিদা। ফলে বাংলাদেশের মতো গার্মেন্টস রপ্তানি প্রধান দেশে সরবরাহকদের গুদামে জমেছে বাতিল হওয়া পণ্যের স্তূপ, যার মূল্য কোটি কোটি ডলার।
আবার মহামারির কারণেও সংক্রমণ পরিহারে বড় একটা সময়জুড়ে কারখানা বন্ধ রাখা হয়। ওই সময়ে শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন দেওয়ার স্বার্থেও অর্থ দেয়নি বিদেশী ক্রেতা গোষ্ঠী। ফলে বাধ্য হয়েই অনেক কারখানা মালিক শ্রমিক ছাঁটাই করেন। যাদের চাকরি টিকে যায়, তাদের ক্ষেত্রেও কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা হয়। ফলে মজুরিও হ্রাস পায়।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান