বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আছে, শিক্ষক নেই
রাঙামাটি সদরের মগবান ইউনিয়নে তঞ্চঙ্গাপাড়া। এখানে রয়েছে দুই তলা বিশিষ্ট একটি হাই স্কুল। পড়ার জন্য শিক্ষার্থীও আছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য নেই কোনো শিক্ষক। ফলে প্রতি বছর ওই এলাকা থেকে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনোর পর ঝড়ে পড়ছে অনেক শিক্ষার্থী। স্থানীয় অভিভাবকদের দাবি, শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বিদ্যালয়টি পুনরায় চালু করা হোক। যদিও কবে নাগাদ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে তা জানাতে পারেনি কেউ।
জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, মাধ্যমিক বিদ্যালয় বিহীন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে ২০১১ সালে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প (এসইএসডিপি) এর আওতায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে তঞ্চঙ্গাপাড়া এসইএসডিপি মডেল হাই স্কুলে ভবন নির্মাণ করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। অবকাঠামোর কাজ শেষ হলে ২০১২ সালে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের কাছে ভবনটি হস্তান্তর করা হয়।
বিদ্যালয়ের পাশে রয়েছে রন্যাছড়ি, হাজাছড়ি, ডুলুছড়ি, মধ্যপাড়া, সোনারাম পাড়া, আমছড়ি, অগৈয়াছড়ি নামে ৭টি গ্রাম। গ্রামগুলোতে বাস করা ৩৮০ পরিবারের অধিকাংশই তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর। তারা পেশায় বেশিরভাগই কৃষক ও মৎস্যজীবী। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩টি। সেগুলো চলছে ভালোভাবেই।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে ওই স্কুলে তিনজন খ-কালীন শিক্ষক রেখে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। তারা ২০১৫ সাল পর্যন্ত ক্লাস নেন। এরপর স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৭ সালে দুজন শিক্ষক দিয়ে আবারও ক্লাস নেওয়া শুরু হয়। ওই বছরের জুনে এলাকাজুড়ে পাহাড় ধসে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তারপর থেকে স্কুলটি বন্ধ রয়েছে।
রন্যাছড়ি গ্রামের বাসিন্দা ও মগবান ইউপির সদস্য সুখী কুমার তঞ্চঙ্গা (৪০) বলেন, মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় এসব এলাকার ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা পঞ্চম শ্রেণির পরই শেষ হয়ে যায়। এবারও তাই হবে। প্রথমদিকে স্থানীয়রা যখন বিদ্যালয়টি চালু করেছিল তখন ৭০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী ছিল। এখন চালু হলে শিক্ষার্থী আরও বাড়বে।
অগৈয়ছড়ি গ্রামের ভাগ্যধন তঞ্চঙ্গ্যা (৪৫) বলেন, আমার দুই ছেলে এক মেয়ে। এক ছেলেকে রাঙামাটি শহরে রেখে পড়াচ্ছি। মেয়েটি এবার ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে উঠবে। ২০১৭ সালে পাহাড় ধসে পাথর ও বালু পড়ে আমাদের কৃষি জমি নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমানে আমার যে অর্থনৈতিক অবস্থা তাতে ছেলেকে শহরে রেখে পড়ানো খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
একই গ্রামের রোমাতি তঞ্চঙ্গা (৪০) জানান, এবার তার এক মেয়ে পিএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। তাকে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করাতে হলে রাঙামাটি শহরে যেতে হবে। কিন্তু সন্তানকে শহরে রেখে পড়ানোর মতন আর্থিক অবস্থা তার নেই। যদিও তার সন্তান পড়তে আগ্রহী বলে জানান তিনি।
সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওই এলাকার ১৩ জন অবিভাবক মিলে একজন গৃহশিক্ষক রেখেছেন। শিক্ষকটি বিদ্যালয়ের একটি কক্ষ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। এসব শিক্ষার্থীরা জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী হিসেবে রেজিস্ট্রেশন দেখায়। বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৩ জন। এর মধ্যে ৯ জন পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে ও চারজন অষ্টম শ্রেণিতে।
সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সাধনা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আমাদের স্কুলটি অন্য স্কুলের মত নয়। আশপাশে স্কুল না থাকায় বাধ্য হয়ে আমরা এখানে পড়ি। স্কুলে শিক্ষক থাকলে আমাদের জন্য সুবিধা হত।
একই শ্রেণির নন্দিতা তঞ্চঙ্গা বলেন, আমাদের শিক্ষক অসুস্থ হলে আমাদের পড়ানোর জন্য কেউ থাকে না। পড়া তখন পুরোপুরি বন্ধ থাকে। এ ছাড়া শিক্ষক অন্য কোথাও কাজে গেলেও এ অবস্থা হয়।
গৃহ শিক্ষক পরান তঞ্চঙ্গা বলেন, এখানে পাঠদানের পরিবেশ তৈরি হলে ১০০ জনের উপরে শিক্ষার্থী ভর্তি হবে।
শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে শিক্ষার্জন থেকে ঝড়ে পড়া রোধে বিশেষ এলাকা হিসেবে বিবেচনায় বিদ্যালয়টি নির্মাণ করা হয়। নানান শর্ত শিথিল করে হলেও এ বিদ্যালয়টি চালিয়ে নিতে সরকারে বিশেষ নির্দেশনাও ছিল। কিন্তু কোনো কিছু করা হয়নি।
এ প্রকল্পের আওতায় দেশের অন্যান্য এলাকায় নির্মাণ করা বিদ্যালয়গুলো অনেক আগে এমপিওভুক্তও হয়ে গেছে বলে জানান রাঙামাটি সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা স্বপন চাকমা। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের যা যা করণীয় করে গেছি। জেলায় গিয়ে আটকে গেছে।’’
মগবান ইউপির সাবেক সদস্য নিরোধ কুমার তঞ্চঙ্গা বলেন, বিদ্যালয়টি নির্মাণে আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম। এখন এটি দেখলে কষ্ট হয়। বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য জনবল নিয়োগ দিতে আমরা উপজেলা অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। কিন্তু জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের পক্ষ থেকে আমাদের কোনো সহযোগিতা করা হয়নি।
মগবান ইউপি চেয়ারম্যান অরুন কান্তি চাকমা বলেন, নির্মাণের পরে স্থানীয়রা চাঁদা তুলে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছিল। ভিজিএফ চাউল নিজেরা না খেয়ে বিক্রি করে শিক্ষকের বেতন দিয়ে হলেও ছেলে মেয়েদের পড়ানোর চেষ্টা করেছিল। বিদ্যালয়টি পুনরায় চালু হওয়া খুবই প্রয়োজন।
উপজেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, অবকাঠামো সম্পূর্ণ নির্মাণ শেষে ২০১২ সালে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের কাছে বিদ্যালয়টি হস্তান্তর করা হয়। এ বিদ্যালয় কমিটির সভাপতি পদাধিকার বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজার রতন চাকমা বলেন, ‘‘শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ায় বিদ্যালয়টি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাঠদান করা সম্ভব হয়নি। বিদ্যালয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে অনেক আবেদন জমা পড়ে। নিয়োগ কমিটিতে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালের প্রতিনিধি না দেওয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে যায়। ফলে এভাবে পড়ে আছে।’’
এ ব্যাপারে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা উত্তম খীসা বলেন, ‘‘আমি প্রতিনিধি দিইনি এটা ঠিক আছে। এর কারণ ছিল। বিদ্যালয়ে কাউকে নিয়োগ দিলে সে তো বেতন পেত না। বেতন না পেলে সে আমার বিরুদ্ধে মামলা করতো। তাহলে আমাকে জেলে যেতে হতো। তাই প্রতিনিধি দিইনি। পরিষ্কার নির্দেশনা পেলে দিতাম।’’
বিদ্যালয়টির সভাপতি ও রাঙামাটি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, ‘‘আমি নতুন এসেছি। আসলে বিদ্যালয়টি সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। বিদ্যালয়টি চালুর জন্য আমার অবস্থান থেকে উদ্যোগ নেব।”