অভিনব বিল জালিয়াতি চক্রে পুলিশ
ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার বিপরীতে মোটা অংকের টাকার বিল তৈরি করত একটি চক্র। জালিয়াতি করে তৈরি করা বিলটি পাশের জন্য নিয়ম অনুযায়ী জমা দিত হিসাব মহানিয়ন্ত্রক অফিসের (সিজিএ) নির্ধারিত অডিটরের টেবিলে।
বিল পাশের নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ শাখার একজন অডিটর যাচাই-বাছাই করে বিলের কপিতে টোকেন লাগিয়ে দেন। এ কাজে ব্যবহার করা হয় অডিটরের আইডি ও পাসওয়ার্ড।
টোকেন লাগানো শেষ হলে বিলে অডিটর নিজে স্বাক্ষর করেন এবং অডিট সুপারের স্বাক্ষর নেন।
সুপার স্বাক্ষর শেষে বিলটি কম্পিউটারে এন্ট্রি দেন এবং নিজের আইডি থেকে বিলটি অ্যাপ্রোভ করেন। বিল অ্যাপ্রোভের পর সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যায় অ্যাকাউন্টস অফিসারের আইডিতে।
পরের ধাপে অ্যাকাউন্টস অফিসার তার আইডি থেকে ইলেকট্রনিক্স ফান্ড ট্রান্সফার করে অডিটরের কাছে পাঠান। এ পর্যায়ে সিজিএ অফিসের তিনজন কর্মকর্তা বিলটি যাচাই-বাছাই করেন। পরে অডিটর ও সুপার বিলটি পাশ করে ক্যাশ শাখায় পাঠান।
ক্যাশ শাখা আইবিএসে বিলটি এন্ট্রি দিয়ে পরে সেটা রেজিস্ট্রারে তালিকাভুক্ত করে চেক ইস্যু করা হয়। পরবর্তীকালে বিলটি ব্যাংকে জমা দিয়ে উত্তোলন করা হয় টাকা।
এভাবে ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের বেতন-ভাতা শাখায় কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক ও এএসআই মিলে গত কয়েক বছরে সিজিএ অফিস থেকে ৫৯টি বিল চেক পাশ করিয়েছেন। আর এসব চেক দিয়ে ১০ কোটি ৮২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
ভয়ঙ্কর এই জালিয়াতিতে দুই পুলিশ সদস্যকে অবৈধভাবে সহায়তা করেছেন সিজিএ অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। আর ইস্যুকৃত চেকগুলো যাচাই-বাছাই ছাড়াই টাকা উত্তোলনে সাহায্য করেছেন ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।
পুলিশের নিজস্ব অনুসন্ধানে এই ভয়ঙ্কর জালিয়াতির তথ্য উঠে এসেছে।
বছরের পর বছর ধরে ভুয়া বিল বানিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করে আসছিল পুলিশ, ব্যাংক ও সিজিএ অফিসের একটি চক্র। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। সর্বশেষ ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের নামে করা বেতন-ভাতা ৩৫ লাখ টাকার একটি চেক জালিয়াতির মাধ্যমে পাশ করিয়ে নেন চক্রের সদস্যরা। ওই চেক কাকরাইলের সোনালী ব্যাংক শাখায় জমা দিয়ে টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে ধরা পড়েন চক্রের সদস্য পুলিশ পরিদর্শক মীর আবুল কালাম আজাদ ও এএসআই মোস্তাফিজুর রহমান।
পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই ভয়ঙ্কর জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত পুলিশ পরিদর্শককে বরখাস্ত ও এএসআইকে চাকুরিচ্যুত করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে জড়িত বাকিরা।
অবশ্য সিজিএ অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, তাদের আইডি ও পাসওয়ার্ড হ্যাক করে এই বিল জালিয়াতির ঘটনা ঘটিয়েছেন দুই পুলিশ সদস্য। তবে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেতন-ভাতার বিলের বিপরীতে পুলিশ পরিদর্শকের নামে ইস্যুকৃত ৩৫ লাখ টাকার বিলের কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি হিসাবরক্ষক শামছুল হক এবং নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ অফিসার এ কে এম তৌহিদুল আলম।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে এ কে এম তৌহিদুল আলমের অফিসে যান টিবিএস প্রতিবেদক। তবে তিনি এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
পুলিশের তদন্ত কমিটির প্রধান, তৎকালীণ ঢাকা ডিআইজি অফিসের অতিরিক্ত ডিআইজি ও বর্তমান চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা অভিযোগ পেয়েছিলাম পুলিশ পরিদর্শক মীর আবুল কালাম আজাদ কিছু চেক সিজিএ অফিস থেকে অতিরিক্ত উত্তোলন করেছেন। সরকারি চেকে টাকা তুলতে গেলে আগে একটি বিল হতে হয়। তবে যে চেকগুলো পুলিশ অফিসার উত্তোলন করেছিলেন, সেখানে ঢাকা রেঞ্জ অফিসের কোনো বিল ছিল না।'
সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, 'এই ঘটনার সঙ্গে ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তবে ওই পুলিশ পরিদর্শক ও এএসআই ডিআইজি অফিসে কাজ করতেন। তারা সিজিএ অফিসে গিয়ে প্রতারণা করেছেন। সিজিএ অফিসের কেউ না কেউ তাদের সহযোগিতা করেছে। কারণ ওই চেকগুলো ঢাকা সিজিএ অফিসে থাকে।'
'এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশ পরিদর্শককে বরখাস্ত ও এএসআইকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। তারা গ্রেপ্তারও হয়েছেন,' যোগ করেন তিনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ অফিসার শফিকুল ইসলামের স্বাক্ষর জাল করে ৩৫ লাখ টাকার বেতন-ভাতার ভুয়া বিল বানিয়ে সিজিএ অফিস থেকে চেক উত্তোলন করেন পুলিশ পরিদর্শক মীর আবুল কালাম আজাদ। চেকটি কাকরাইলের সোনালী ব্যাংকে জমা দিয়ে টাকা উত্তোলনের চেষ্টাকালে বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকের সন্দেহ হয়।
পরে ব্যাংক ও সিজিএ অফিসের অনুসন্ধানে স্বাক্ষর জালিয়াতির ঘটনা সামনে আসে। এই ঘটনায় শফিকুল ইসলাম বাদী রমনা থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তদন্তাধীন রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে টিবিএসকে শফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমার স্বাক্ষর জালিয়াতি করে এই অপকর্ম করা হয়েছে। আমি রমনা থানায় মামলা করেছি। মামলাটি দুদক তদন্ত করছে। শুনেছি হাইকোর্টে মামলাটি স্টে করা হয়েছে। আসামি জামিনে রয়েছেন।'
এই জালিয়াতির সঙ্গে সিজিএ অফিসের কারও সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। সিজিএ অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আইডি হ্যাক করে এই জালিয়াতি করা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা তার।
যেভাবে সামনে এল এই ভয়ঙ্কর জালিয়াতি
২০১৯- ২০২০ অর্থবছরে ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের বেতন কোডের অনুকূলে বাজেট বরাদ্দ ও ওই অর্থ বছরের বরাদ্দকৃত বাজেটের সঙ্গে প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ের প্রদর্শিত ব্যয় ও অবশিষ্ট অর্থের অসামঞ্জ্যতা দেখা দেয়।
এছাড়াও চক্রের সদস্য পুলিশ পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে কাকরাইলের সোনালী ব্যাংকে বেতন-ভাতার বিল হিসেবে ৩৫ লাখ টাকার একটি চেক জমা দেন। টাকা ট্রানজেকশনের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে চেকটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঠালে তাদের সন্দেহ হয়। পরে ব্যাংক লক্ষ করে, চেকের ওপর নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ অফিসার শফিকুল ইসলামের যে সাক্ষর রয়েছে, সেটি জাল। পরে ব্যাংক থেকে অর্থ ছাড় না করে সিজিএ অফিসকে জানায়।
এরপর শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলা করেন।
এই ঘটনা অনুসন্ধানে বর্তমান চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন কমিশনার ও তৎকালীন ঢাকা ডিআইজি অফিসের অতিরিক্ত ডিআইজি সালেহ মোহাম্মদ তানভীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।
এই ঘটনা অনুসন্ধানে নেমে পুলিশের তদন্ত কমিটি ভয়ঙ্কর জালিয়াতির সন্ধান পায়। পুলিশের পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বেতন-ভাতার বিপরীতে বিল জালিয়াতি করে সিজিএ অফিস থেকে বিভিন্ন সময় মোট ৫৯ চেক ইস্যু করিয়েছেন, যাতে টাকার পরিমাণ ১১ কোটি ১৭ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্য থেকে বিভিন্ন সময় ১০ কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন আবুল কালাম আজাদ।
পুলিশের তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, চেকগুলোর মধ্যে ৪৯ চেক উত্তোলনে সোনালী ব্যাংক কাকরাইল শাখার ব্যবস্থাপকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অবৈধভাবে লাভবান হয়ে এ কাজে সহায়তা করেছেন। বাকি ১০ চেকের টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক ভিআইপি রোড শাখার ব্যাংক কর্মকর্তাদের একই ভূমিকা ছিল।
তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে ওইসব চেকের বিপরীতে যাচাই-বাছাই ছাড়া কেন অর্থ ছাড় করেছে, এসব তথ্য চেয়ে ব্যাংক থেকে কোনো সাড়া পায়নি। আদালত না চাইলে ব্যাংক তথ্য দেবে না বলে তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ওই ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
দুদকের যেহেতু ব্যাংকের বিষয়গুলো তদন্তের এখতিয়ায় রয়েছে, তাই তদন্ত কমিটি দুদককে দিয়ে বিষয়টি অনুসন্ধানের কথা বলেছে।
পুলিশের তদন্ত কমিটির কাছে সিজিএ অফিসারদের দেওয়া জবানবন্দিতে যা রয়েছে
পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী এই জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধানে সিজিএ অফিসের সংশ্লিষ্ট পুলিশ শাখার একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর জবানবন্দি নিয়েছেন তারা।
জবানবন্দিতে অধিকাংশ কর্মকর্তা ঘটনা সম্পর্কে জানেন না বলে বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে অডিটর রফিকুল ইসলাম দুই দফা জবানবন্দি দিয়েছেন। গত বছরের অক্টোবর তিনি প্রথম দফায় জবানবন্দি দেন। সেখানে বলেন, '২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুলিশ শাখা-১ যোগদান করি। পরের বছর জুলাই পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে এ ধরনের কোনো বিলে টোকেন কিংবা বিল পাশ করি নাই।'
গত বছর ১০ ফেব্রুয়ারি জবানবন্দি দেওয়ার সময় তিনি একদিনের সময় চেয়ে আবেদন করেন। পরের দিন জবানবন্দিতে বলেন, 'আমার জানামতে কোনো জালিয়াতির বিল আমি পাশ করি নাই। অডিটর শুধু বিলে টোকেন ও বিলটি এন্ট্রি করা ছাড়া কোনো কাজের অপশন নেই। তবে আমার পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে বিলে টোকেন ও বিল এন্ট্রি করা হয়েছে কি না , তা আমার জানা নেই। চেক এন্ট্রি করার দায়িত্ব ক্যাশ শাখার। এটা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। অডিটর ও অফিসারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে এই জালিয়াতি করে তা আমার জানা নেই।'
এছাড়াও পুলিশ-১ শাখায় কর্মরত মোহাম্মদ মনির হোসেন, ক্যাশ শাখার তৎকালীল এস এ এস সুপারিনটেনেডেন্ট জাফর উল্লাহ, অডিটর রিপন আরা চৌধুরী জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই তাদের দায়িত্ব বর্ণনা করে এই জালিয়াতির ঘটনা সম্পর্কে অবগত নন বলে দাবি করেছেন।
তবে যার সাক্ষর জালিয়াতি করা হয়েছে, সেই অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার বলেন, 'সিজিএ অফিস থেকে এএসআই মোস্তাফিজুর রহমান ৩৫ লাখ টাকার একটি চেকে ছাড় করান। সেখানে আমার স্বাক্ষর রয়েছে। তারা আমার স্বাক্ষরটি জাল করেছেন। চেকটি পুলিশ পরিদর্শকের নামে কিভাবে গ্রহণ করেছেন, সেটা আমার জানা নেই। এছাড়া বিলটি দাখিলের পরে সিজিএ অফিসের পুলিশ শাখার আইবিএস+ কিভাবে এন্ট্রি হয়েছে, সেটা আমার জানা নেই।'
তদন্ত কমিটির সুপারিশ
ভবিষ্যতে এ ধরনের জালিয়াতির পুনরাবৃত্তি বন্ধে পুলিশের তদন্ত কমিটি বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে। তদন্ত কমিটি বলেছে, দুই পুলিশ সদস্যসহ চিফ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসার ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করে পুলিশের সিআইডিকে দিয়ে অধিকতর তদন্ত করতে হবে।
এই জালিয়াতি বন্ধে ঢাকা রেঞ্জ অফিসসহ পুলিশের সকল ইউনিট অফিসের বাৎসরিক অর্থ বরাদ্দ না দিয়ে মাসিক বরাদ্দের সুপারিশ করেছেন তদন্ত কমিটি। এছাড়াও আয়ন বেয়ন কর্মকর্তাদের ছাড় ছাড়া ব্যাংক যেন কোনো অর্থ ছাড় না করে, সেটা নিশ্চিত করা।
এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে পুলিশ সদর দফতর, অর্থ মন্ত্রণালয়, হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, সিআইডি ও বাংলাদেশ পুলিশ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা।