অনাবৃষ্টিতে সুন্দরবনে কমেছে মধু উৎপাদন
সুন্দরবনের খাঁটি মধুর চাহিদা প্রচুর। মৌসুম এলেই সুন্দরবনে ছুটে যান মৌয়ালরা। বনের গাছে মৌমাছির বাঁধা চাক থেকে মধু সংগ্রহ করেন এসব মৌয়ালরা। এরপর মৌয়ালদের সংগ্রহ করা সুন্দরবনের মধু চলে যায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বর্তমানে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের মৌসুম চলছে। তবে বৃষ্টি না থাকায় এ বছর সুন্দরবন থেকে মধু আহরণের পরিমাণ কমেছে।
মৌসুম শুরুর ২৫ দিনে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ হয়েছে ১৩৯৪ কুইন্টাল। মৌয়াল ও বন বিভাগের মতে, বৃষ্টি না হওয়ার কারণে এ বছর সুন্দরবনে মৌমাছির চাকে মধুর পরিমাণ কমেছে, মধুর সংকট দেখা দিয়েছে।
১ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের মৌসুম। মৌয়ালদের মধু আহরন চলবে জুন মাস পর্যন্ত। সুন্দরবন থেকে খলিশা, বাইন, গরান ও কেওড়া ফুলের মধু সংগ্রহ করেন মৌয়ালরা।
খুলনা বিভাগীয় বন কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্চের বুড়িগোয়ালীনি, কদমতলা, কৈখালী ও কোবাদক এই চারটি ফরেস্ট স্টেশন থেকে ৩৯৬ টি বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) নিয়ে মধু সংগ্রহের জন্য সুন্দরবন গেছেন ১৫০০ জন মৌয়াল। ১ এপ্রিল- ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ হয়েছে ১৩৯৪ কুইন্টাল। মোম সংগ্রহ হয়েছে ৪১৮.২০ কুইন্টাল। রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৪ লাখ ৬৩ হাজার ৭০০ টাকা।
২০১৯-২০ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ হয়েছিল ২০০৬.৫ কুইন্টাল। মোম সংগ্রহ হয়েছিল ৬০১.৯৫ কুইন্টাল। মধু ও মোমে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২১ লাখ ৬ হাজার ৮২৫ টাকা। মধু সংগ্রহ করতে ৫৭৩ টি বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) নিয়ে সুন্দরবন গিয়েছিলেন ৪ হাজার ১৩ জন।
সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবন উপকূলীয় ইউনিয়ন গাবুরা। এই ইউনিয়নের ৪৩ হাজার বাসিন্দাদের অধিকাংশই উপকূলীয় নদী ও সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে যান গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনীমুখা গ্রামের বনজীবী শহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, সুন্দরবনে যাওয়ার জন্য ফরেস্ট অফিস থেকে অনুমতিপত্র নিতে হয়। ১৫ দিনের জন্য অনুমতিপত্র দেয় বন বিভাগ। বৃষ্টি না হওয়ার কারণে মৌমাছির চাকে এবছর চাকে মধু খুব কম বলে জানান তিনি।
মৌয়াল শহিদুল ইসলাম বলেন, "পহেলা জুন ১০ জনের মৌয়াল দলের সঙ্গে একটি বোটে আমি সুন্দরবনে গিয়েছিলাম। মাত্র ৩৫ কেজি গারন ফুলের মধু পেয়েছি। ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি ২৫ হাজার টাকায়। মাত্র আড়াই হাজার টাকা আমি ভাগে পেয়েছি। অথচ খরচ হয়েছিল প্রত্যেকের ১৫ হাজার টাকা করে। সুন্দরবনে যাওয়ার জন্য নৌকা প্রস্তুত করতে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। এ বছর বনে মধু খুব কম।"
গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের মৌয়াল মাহবুব গাজী জানান, "সুন্দরবনে বাঘ, সাপ, কুমির হিংস্র সব প্রাণির সঙ্গে যুদ্ধ করেই মধু সংগ্রহ করতে হয় আমাদের। জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। জীবনের ঝুঁকি আর টাকা খরচ করে সুন্দরবনে গেলে এবছর খরচের টাকা উঠছে না। বৃষ্টি না থাকায় ফুলে মধু নেই। মৌমাছি মধু সংগ্রহ করতে পারছে না। খালি চাকগুলো পড়ে আছে। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত মধু সংগ্রহের মৌসুম হলেও মূলত এপ্রিল মাসেই বেশী মধু সংগ্রহ হয়ে থাকে। এ বছর কিছু চাকে মধু থাকলেও সেটি খুব সামান্য। ফলে কোন মৌয়ালের এ বছর খরচই উঠছে না।"
সুন্দরবন উপকূলীয় বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়নের নীলডুমুর খেয়াঘাট এলাকার বড় মধু ব্যবসায়ী তোহিদুল ইসলাম। মধুর অনেক খুচরা বিক্রেতা ও রাজধানীর একটি ফাস্টফুড কোম্পানিকে মধু দেন এই ব্যবসায়ী। সুন্দরবনের মধু ব্যবসায়ী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, "এ বছর সুন্দরবনে ১০টি নৌকায় শতাধিক মৌয়ালদের আমি মধু সংগ্রহ করতে বনে পাঠিয়েছি। খরচ হয়েছে ৩৩ লাখ টাকা। এ বছর বনে মধু নেই, সংকট। গত বছর ১৫০ মন মধু সংগ্রহ হয়েছিল। এ বছর মাত্র ৫০ মন মধু পেয়েছি। প্রতি কেজি বিক্রি করেছি ৮০০ টাকায়। ৩৩ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকাও উঠেনি। যদি বৃষ্টি হয় তবে গাছে ফুলে মধু আসবে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করতে পারবে। আর যদি বৃষ্টি না হয় তবে এ বছর আমার অনেক টাকার লোকসান হয়ে যাবে।"
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্চের বুড়িগোয়ালীনি ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ বলেন, "মৌয়ালরা যারা সুন্দরবন থেকে ফিরছেন সকলেই অভিযোগ করছেন, এবছর বনে মধু নেই। বৃষ্টি না থাকার কারণে মূলত এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।"
এই কার্যালয় থেকে মধু সংগ্রহের জন্য চলতি এপ্রিল মাসে প্রথম ধাপে বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) দেওয়া হয়েছে ১৪৮টি। এই বিএলসিতে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের জন্য সুন্দরবনে গিয়েছেন ১০৭৬ জন মৌয়াল। মধু সংগ্রহ হয়েছে ৫৩৮ কুইন্টাল। যার মূল্য ৪ লাখ তিন হাজার ৫০০ টাকা। মোম সংগ্রহ হয়েছে ১৬১.৪০ কুইন্টাল। যার মূল্য এক লাখ ৬১ হাজার ৪০০ টাকা।
খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসনি হোসেন বলেন, "চলতি বছরে মৌসুমে সুন্দরবনে মধুর পরিমাণ কমেছে। বৃষ্টি না থাকায় খাবার পাচ্ছে না মৌমাছিরা। বনের ভেতরে দেখেছি, মৌমাছিরা খাবার না পেয়ে পানি খাচ্ছে। বৃষ্টি হলে গাছের ফুলে মধু আসতো মৌমাছিরা সেই মধু খেতো ও চাকে জমা করতো। এ বছর ফুলও কম। ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ হয়েছে ১৩ ৯৪ কুইন্টাল। এখনো মে ও জুন দুই মাস মধু সংগ্রহ চলবে। সব মিলিয়ে এ বছর কতটুকু মধু সংগ্রহ হল সেটি মৌসুম শেষ হলে জানা যাবে।"