ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কিশোর অপরাধীরা ‘অপ্রতিরোধ্য’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলায় রাস্তা থেকে ১২ বছর বয়সী এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে ২০১৯ সালের ২৪ আগস্ট মামলা হয় একই উপজেলার তালশহর ইউনিয়নের কিশোর মো. ইমনের (১৫) বিরুদ্ধে। পরবর্তী সময়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলে আদালতের নির্দেশে ইমনকে গাজীপুরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। পুলিশি তদন্তে ধর্ষণের সত্যতা মিললেও ওই কিশোরের পরিবারের দাবি, অভিযোগটি মিথ্যা। তাকে ফাঁসানো হয়েছে।
ছোটবেলা থেকে একটু দুষ্টু প্রকৃতির হওয়ায় ক্লাস সেভেনে থাকতে তার পড়ালেখা বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন ইমনের বড় ভাই রিটন। তিনি বলেন, ‘‘দেড় বছর আগে স্কুল ছাড়লেও তার মধ্যে অপরাধের কোনো প্রবণতা দেখা যায়নি।’’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইমনের এক প্রতিবেশী জানান, ইমনের বাবা পার্শ্ববর্তী মৈশাইর বাজারে কলা বিক্রি করেন। তার এক ভাই অটোরিকশা চালান। ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে ইমন কিভাবে সম্পৃক্ত হল তা তিনি বুঝতে পারছেন না। লেখাপড়া না করে অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরার কারণে এমনটা হতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি।
তিনি আরও জানান, ইমন সারাদিন কার সঙ্গে চলাফেরা করে, কী করে এগুলোর খোঁজ তারা বাবা-মা রাখতেন না।
ধর্ষণের শিকার একই উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ওই কিশোরীর মা জানান, তার মেয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। আর্থিক অনটনের কারণে তার লেখাপড়া বন্ধ করে তাকে একটি চামড়া কারখানায় চাকরি করতে পাঠানো হয়। তালশার ইউনিয়নের ইমন প্রায়ই পাশ^বর্তী হাটে কলা বেচতে এসে পানির খাওয়ার জন্য তাদের বাড়িতে আসতো।
তিনি বলেন, ‘‘গত ২১ আগস্ট বিকেলে কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তা থেকে মেয়েকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে ইমন। এ ঘটনায় ২৪ আগস্ট তার বিরুদ্ধে আশুগঞ্জ থানায় একটি মামলা করি। পুলিশ ওইদিনই তাকে গ্রেফতার করে।’’ ইমনের পরিবার টাকা নিয়ে মামলাটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য চাপ দেয় বলেও জানান ওই কিশোরীর মা।
আশুগঞ্জ থানার ওসি জাবেদ মাহমুদ বলেন, ‘‘ইমনের সঙ্গে ওই কিশোরীর আগে থেকেই জানাশোনা ও সম্পর্ক ছিল। মামলার তদন্তে কিশোরীকে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।’’
ইমনের মতো অনেক কিশোর এখন মারামারি, চুরি, ছিনতাই ও যৌন নিপীড়নের মতো ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মূলত পরিবারের অসচেতনতা, বঞ্ছনা, সামাজিক অবক্ষয় এবং সঙ্গ দোষে অনেক কিশোরের নাম এখন পুলিশের অপরাধীদের তালিকায় বলে মনে করেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ার কারণে আদালত থেকে এসব কিশোর অপরাধীরা সহজেই জামিন পেয়ে আবারও অপরাধে জড়াচ্ছে। ফলে ‘অপ্রতিরোধ্য’ হয়ে উঠা এসব কিশোর অপরাধীদের নিয়ে পুলিশকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে।
পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাতটি উপজেলায় বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধে সম্পৃক্ত কিশোর অপরাধীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে মাদককারবারিরা কিশোরদের মাদক পরিবহণের কাজে ব্যবহার করছে। আর টাকার লোভে কিশোররাও মাদককারবারিদের ফাঁদে পা দিয়ে অপরাধে জড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে এসব কিশোরদের কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে মাদককারবারিতেও।
জেলা পুলিশ জানায়, গত বছর মারামারি, চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিং ও মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধের ৫০টি মামলায় ৬৮ জন কিশোরকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে সদর থানার ২১টি মামলায় ৩০ জন, আশুগঞ্জ থানার দুইটি মামলায় দুইজন, সরাইল থানার সাতটি মামলায় আটজন, নাসিরনগর থানার একটি মামলায় একজন, নবীনগর থানার তিনটি মামলায় তিনজন, কসবা থানার ১০টি মামলায় ১২ জন এবং আখাউড়া থানার ছয়টি মামলায় ১২ জন কিশোর আসামি রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। এছাড়াও অর্ধশত কিশোরকে আটকের পর অপরাধের ধরন ও মাত্রা বিবেচনা করে তাদের পরিবারের সদস্যদের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। জেলায় কোনো সংশোধনাগার না থাকায় মামলায় চালান করা বেশিরভাগ কিশোরকে আদালতের নির্দেশে গাজীপুরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। আর বাকিরা জামিনে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলায় কিশোর অপরাধীর সংখ্যা দিন-দিন বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের পরিচয় ব্যবহার করেও অনেক কিশোর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারি, বাসাবাড়িতে চুরি, ছিনতাই ও মেয়েদের ইভটিজিং করাসহ নানা অপরাধের দায়ে প্রায়ই এসব কিশোর অপরাধীদের আটক করে পুলিশ। কিছু অপরাধীকে আদালতের নির্দেশে সংশোধনের জন্য সমাজ সেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
পুলিশ জানায়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ আটক কিশোরদের বিরুদ্ধে মামলা না দিয়ে জেলা শহরে থাকা সরকারি শিশু পরিবারে পাঠাতে চাইলে তাদেরকে নিতে অনীহা প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ। পুলিশ তখন বাধ্য হয়েই মুচলেকা দিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়। আর পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও অপরাধে লিপ্ত হয় তারা। ফলে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না কিশোর অপরাধ। এতে পুলিশের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কিশোর অপরাধীরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মাসুদুল হাসান তাপস বলেন, কোনো কিশোরের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা থাকলে আদালতের নির্দেশে তাকে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। ‘‘আমাদের শিশু পরিবারগুলোতে সরকারি খরচে এতিম শিশুদের লালন-পালন করা হয়। সেখানে কোনো মামলার অভিযুক্তকে আমরা রাখতে পারিনা। দুই-তিন দিনের জন্য রাখতে হলে তাদের জন্য চট্টগ্রামে আমাদের সেইফ হোম রয়েছে।’’
রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের পরিচয় ব্যবহার করে অপরাধে জড়ানোর বিষয়টি স্বীকার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি সুজন দত্ত বলেন, ‘‘কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না বলেই অপরাধ এবং অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে। এ বিষয়ে প্রশাসনকেই কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।’’
তবে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, অপরাধ জগত থেকে কিশোরদের ফিরিয়ে আনতে তাদের পরিবারকেই প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে। তাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে হবে।
জেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি পীযূষ কান্তি আচার্য বলেন, কিশোর অপরাধ একটি মানসিক সমস্যা। যারা এসব সমস্যায় ভুগছে তাদের বেশিরভাগই স্কুলছাত্র। সেজন্য প্রতিটি স্কুলে মনরোগ চিকিৎসক নিয়োগ করা প্রয়োজন। আর অপরাধের সাজা নয়, বরং সংশোধনাগারে রেখেই কিশোরদের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগ দিয়ে তাদেরকে সমাজ ও দেশের সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ১নং আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর তাসলিমা সুলতানা খানম নিশাত বলেন, কিশোরদের দিয়ে অপরাধ করানো খুব সহজ। আর যারা অপরাধ করছে তারা একেবারেই সাধারণ পরিবারের। যেহেতু বয়স কম তাদেরকে আদালত থেকে সহজেই জামিন দেওয়া হয়। কারণ জেলায় কোনো সংশোধনাগার নেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বন্দে আলী বলেন, অনেক সময় শিশু-কিশোরদের সামনে আমরা এমন কিছু কাজ করি যাতে তারা খারাপ কাজে প্রভাবিত হয়। তাই তাদের সামনে এমন কিছুই করা যাবে না। তাদের মধ্যে নৈতিক মুল্যবোধ তৈরি করে সুপথে ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য পরিবারকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মুহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন, আইন দিয়ে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কী কারণে কিশোররা অপরাধে জড়াচ্ছে সেটি আগে খতিয়ে দেখতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় পারিবারিক বঞ্ছনা ও নিম্ন আর্থ-সামজিক ব্যবস্থা এবং সঙ্গ দোষে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তারা। বাবা-মাসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কিশোর অপরাধ দমন সম্ভব নয়।