ভ্যাকসিনের জন্য বাজেটে ১০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখবে অর্থ মন্ত্রণালয়
আগামী বছরের জুনের মধ্যে দেশের ১০ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে নতুন অর্থবছরের বাজেটে ১০,০০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখছে অর্থ মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরও এ খাতে একই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা ছিল, তবে ভ্যাকসিন কিনতে না পারায় দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি অব্যায়িত রয়ে গেছে।
আগামী ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যাপ্ত পরিমাণ ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগিদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুত প্রায় ২৪,০০০ কোটি টাকার বাজেট সহায়তা থেকে বাড়তি অর্থ ব্যয় করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। এছাড়া, ভ্যাকসিন কেনাসহ স্বাস্থ্যখাতের অবকাঠামো উন্নয়নে বিশ্ব ব্যাংকসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে চলমান ৬৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প থেকেও মূল্য পরিশোধ করবে সরকার।
তবে কোন থার্ড পার্টির মাধ্যমে ভ্যাকসিন না কিনে সরাসরি উৎপাদক কোম্পানি থেকে সরকারিভাবে কিনতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিয়েছে অর্থবিভাগ।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি করার পর ভ্যাকসিন না পাওয়ার প্রেক্ষাপটে এমন মত দিয়েছে অর্থবিভাগ। এছাড়া, থার্ড পার্টি হিসেবে বেক্সিমকো ফার্মাকে প্রতি ডোজে ১ ডলার করে কমিশন পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে। ২০ কোটি ডোজের ক্ষেত্রে এ হারে কমিশন দিতে গেলে বাড়তি খরচ হবে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আগামী অর্থবছরের মধ্যে সরকার দেশের প্রাপ্ত বয়স্ক সকল জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনবে। এজন্য প্রায় ২০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের দরকার হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের মূল্য ৫-১০ ডলার। আমাদের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ২০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনতে প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকা লাগতে পারে।
'আপাতত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। তাদের পাশের দেশ কানাডাও যুক্তরাষ্ট্র থেকে চাহিদা অনুযায়ী ভ্যাকসিন পাচ্ছে না। তাই বাংলাদেশ আপাতত চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিনের ওপরই নির্ভর করছে। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে, তাও কেনা হবে'- যোগ করেন তিনি।
ওই কর্মকর্তা জানান, আগামী বাজেটের মূল প্রতিপাদ্য হলো- 'জীবন জীবিকার প্রাধান্য ও আগামীর বাংলাদেশ'। অর্থাৎ, ব্যাপকহারে ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের জীবন সুরক্ষিত করার মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে গতি ফেরানোই আগামী বাজেটের মূল লক্ষ্য। এছাড়া, কর্মহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ সহায়তা এবং ওএমএস সুবিধা অব্যাহত রাখা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাকসিন কেনাসহ কোভিড পরিস্থিতি মোকাবেলায় গঠিত ১০,০০০ কোটি টাকার তহবিল থেকে প্রায় ২৮০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের মূল্য হিসেবে সেরাম ইনস্টিটিউটকে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা অগ্রিম পরিশোধ করা হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৭০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে বাংলাদেশ।
কোভিড মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তহবিল থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করেছে। এছাড়া, চলমান লকডাউনে কর্মহীন ও দরিদ্র ৩৫ লাখ পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার হিসেবে এই তহবিল থেকে ২৫০০ টাকা করে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এতে প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ভ্যাকসিন না পাওয়ায় সরকার জরুরি ভিত্তিতে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ও চীনের সিনোফার্ম ভ্যাকসিন কেনার চেষ্টা করছে। তবে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং জানিয়েছেন, আগে থেকে যেসব দেশ অর্ডার করে রেখেছে, তাদের ভ্যাকসিন সরবরাহ করার পর বাংলাদেশ সিনোফার্মের ভ্যাকসিন পাবে, তাতে কয়েক মাস লাগতে পারে।
এ প্রেক্ষাপটে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ। দেশটি প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের দাম চেয়েছে ৯.৫ ডলার। তবে রাশিয়ার ভ্যাকসিনটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অননুমোদিত হওয়ায় বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নের চলমান প্রকল্প থেকে এর মূল্য পরিশোধে আপত্তি রয়েছে ঋণদানকারী সংস্থাটির। আগামী জুনের মধ্যে এই ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে চলতি অর্থবছরের থোক বরাদ্দ থেকে এর মূল্য পরিশোধ করবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছর বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও এআইআইবি থেকে ১২,০০০ কোটি টাকা বাজেট সহায়তা পাওয়া গেছে, আগামী অর্থবছর এসব সংস্থাসহ বিভিন্ন উৎস থেকে এর দ্বিগুণ পরিমাণ বাজেট সহায়তা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি মিলেছে।
তাই ভ্যাকসিন কেনার জন্য অর্থের কোন সংকট হবে না। বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হলে আগামী অর্থবছরের বাজেট সহায়তা থেকে ভ্যাকসিনের মূল্য যোগান দেওয়া হবে।
আগামী অর্থবছর বিশ্ব ব্যাংক ৫৫০ মিলিয়ন ডলার, এডিবি ১০০০ মিলিয়ন ডলার, দ্য ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি ২০০ মিলিয়ন ডলার, জাইকা ৩০০ মিলিয়ন ডলার, ইউরোপীয় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ৩০০ মিলিয়ন ডলার, এআইআইবি ৩০০ মিলিয়ন ডলার ও কোরিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি ২৫০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা দেবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাজেট সহায়তা হলো সহজ শর্তের ঋণ। এসব ঋণের গড় সুদ হার ২ শতাংশ এবং সরকার তার প্রয়োজন অনুযায়ী যে কোন কাজে এ অর্থ ব্যয় করতে পারে। এজন্য ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছে কোন জবাবদিহি করতে হয় না।