মজুত শেষ হওয়ায় চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় বন্ধ হয়ে গেছে টিকা কার্যক্রম
'টিকার মজুত শেষ হওয়ায় পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত টিকা কার্যক্রম বন্ধ থাকবে'-দরজায় এই নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়ে ভ্যাকসিন সেন্টার বন্ধ করে দিয়েছে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। টিকা সংকটের কারণে শুধু চট্টগ্রাম নয়, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় টিকা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকাতেও অধিকাংশ সেন্টারে আর ৪-৫ দিন টিকা কার্যক্রম চালানো যাবে।
টিকার সংকটের কারণে ১৪ লাখের বেশি মানুষের দ্বিতীয় ডোজ টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার পাশাপাশি আবার দেশব্যাপী টিকা কার্যক্রম শুরু করা নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। মাঝপথে টিকাদান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় টিকাগ্রহীতাদের মতই হতাশ টিকা প্রদানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ চট্টগ্রাম মহানগরের দশটি টিকাকেন্দ্রের সবগুলোতেই টিকা কার্যক্রম বন্ধের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় আন্দরকিল্লা জেনারেলে হাসপাতাল ও সিটি কর্পোরেশনে জেনারেল হাসপাতালে বিক্ষোভ করছেন প্রথম ডোজ টিকা গ্রহীতারা।
দুবাই প্রবাসী মোরশেদ আলম বলেন, 'আমার দ্বিতীয় ডোজ এর টিকার তারিখ ছিল ৭ মে। সেদিন আজকের (১৯ মে) তারিখ দিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আজ এসে দেখছি টিকা দেওয়া বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। আগামী ২৫ তারিখ আমার ফ্লাইট, এ অবস্থায় কি করবো বুঝতে পারছি না।'
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের টিকাকেন্দ্রে যে পরিমাণ টিকা রয়েছে তা দিয়ে আর ৪-৫ দিন কার্যক্রম চালানো যাবে।
এই কেন্দ্রের সমন্বয়ক, ডা. আশরাফুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'যেসব মানুষের টিকা প্রয়োজন কিন্তু তারা তা পাবেনা সেজন্য আমাদের খারাপ লাগছে। প্রথম ডোজ টিকা নেয়া অনেকেই দ্বিতীয় ডোজ টিকা না পেয়ে নিজেকে বঞ্চিত ভাবতে পারে এমনকি বিক্ষোভও করতে পারে'।
ডা. আশরাফুল হক বলেন, 'টিকা প্রদান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে আবার মানুষকে নতুন করে টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করা কঠিন হয়ে যাবে। যারা ভ্যাকসিন সেন্টারে কাজ করছেন তাদের আবার আগের কাজে ফেরত পাঠানো হবে। ফলে নতুন করে ভ্যাকসিনেশন শুরু হলে এখনকার এই পরিবেশ নাও থাকতে পারে'।
টিকা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ভ্যাকসিন সেন্টারগুলোতে কাজ করা নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের আবার তাদের আগের কাজের জায়গায় ফেরত পাঠানো হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) টিকাকেন্দ্রের এক নার্স দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কোন ধরণের অভিযোগ ছাড়া চার মাস ধরে আমরা টিকা কার্যক্রমের সঙ্গে রয়েছি। এখন আবার আমাকে কিডনি ডিপার্টমেন্টের ওয়ার্ডে ফিরে যেতে হবে। আবার ভ্যাকসিনেশন শুরু হলে ওয়ার্ডের কাজ ছেড়ে আবার আমাকে এখানে ফিরতে হতে পারে। টানা কয়েক মাস এক ধরণের কাজে অভ্যস্ত হওয়ার পর মাঝপথে সেটি থেমে যাওয়ায় কিছুটা খারাপ লাগছে'।
টিকা কেন্দ্রগুলোকে অনেক বেশি সহায়তা করেছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। সারা দেশের টিকা কেন্দ্রগুলোতে রেড ক্রিসেন্টের সাড়ে চার হাজার ভালান্টিয়ার কাজ করেছে। এখন অনেক টিকা কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রেড ক্রিসেন্টের ভলান্টিয়াররা অন্য কাজ করছেন, পুনরায় ভ্যাকসিনেশন চালু হলে তারা আবার ফিরে আসবেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি দেশে অত্যন্ত ভালোভাবে কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে ৪০ বছর ও ততোর্ধদের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন দিয়ে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। মাত্র ১২ দিনের ভেতর দেশের ১ শতাংশের বেশি জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি টিকাদানের ক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবে ২৪তম অবস্থানে আসে বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অবস্থান হয় দ্বিতীয়।
গত ৮ এপ্রিল দ্বিতীয় ডোজ টিকাদান শুরু হয়।
তবে ভারতে মহামারির দ্বিতীয় ওয়েভের প্রভাবে টিকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ফলে দেশটির সেরাম ইনস্টিটিউ থেকে বাকি ডোজ টিকা পাওয়ার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা যায়। ফলস্বরূপ টিকাদান কর্মসূচিতেও এর প্রভাব পড়ে।
এরইমধ্যে চীনের সিনোফার্মের ৫ লাখ ডোজ টিকা দেশে এসেছে। আর আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে কোভ্যাক্স থেকে আসবে ১ লাখ ৬ হাজার ডোজ ফাইজারের টিকা।
তবে এসব টিকা সাধারণ মানুষ পাবে না। মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন শিক্ষার্থী ও টেকনোলজিস্টরা চীনা টিকা পাবে। ফাইজারের টিকা শুধু ঢাকায় দেয়া হবে তবে কারা পাবে তা এখনো ঠিক হয়নি। সরকার চীন ও রাশিয়া থেকে টিকা কেনার চেষ্টা করছে, তবে কবে বা কত মানুষের জন্য সে টিকা কেনা হবে তা এখনো ঠিক হয়নি। তাই আবারো কবে দেশব্যাপী টিকা দেয়া শুরু হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, 'এত সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত টিকাদান কার্যক্রম টিকার সংকটের কারণে হঠাৎ থেমে যাচ্ছে এটাতে আমাদেরও খারাপ লাগছে। আমরা বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে যোগাযোগ করছি টিকা পেতে। আশা করা যাচ্ছে শিগগিরই টিকা পাওয়া যাবে'।