মহামারিতে বিদেশি সহায়তার ৩৪ শতাংশ অব্যবহার্য মেট্রো রেল প্রকল্পে
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রজেক্ট (লাইন-৬) প্রকল্পে গত অর্থবছর জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থার (জাইকা) সহজ শর্তের ঋণের ৩৭৮০ কোটি টাকা বরাদ্দের মাত্র ৬৬ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। বিদেশি সহায়তার ১২৫৭.৫৩ কোটি টাকাই অব্যবহার্য রয়েছে রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেল নির্মাণ কাজে।
সরকারের তহবিলের বরাদ্দের প্রায় শতভাগ ব্যয় হলেও সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকারে থাকা এ প্রকল্পে ২০২০-২১ অর্থবছরে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৭ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ তহবিল ও বিদেশি সহায়তায় মোট ৫৫৪২.৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দ থেকে গত অর্থবছর ব্যয় হয়েছে ৪২৮৫.৩ কোটি টাকা।
মেট্রো রেলের স্বত্বাধিকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এর বার্ষিক এডিপি বাস্তবায়ন পর্যালোচনা প্রতিবেদনে এ সব তথ্য উঠে এসেছে। ডিএমটিসিএল'র প্রকল্পগুলোতে বিদেশি সহায়তার বড় একটা অংশ ব্যবহৃত না হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের এডিপি পর্যালোচনা সভায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমএএন ছিদ্দিক বলেন, "বিদেশি সহায়তার তহবিল ব্যবহারের বিষয়টি শুধু আমাদের দেশের ওপর নির্ভর করে না। দাতা দেশের পাশাপাশি পণ্য ও সেবা কেনাকাটার উৎস দেশের করোনা পরিস্থিতির উপরও এ তহবিলের ব্যবহার অনেকটাই নির্ভরশীল"।
তিনি বলেন, "ডিএমটিসিএল মূলত জাইকার তহবিল ব্যবহার করছে। এ সংস্থার তহবিল ব্যবহারে সংস্থাটি অন্যান্য দেশের চাইতে এগিয়ে আছে। জাইকার অর্থায়নে যে সব প্রকল্প চলছে তার মধ্যে ডিএমটিসিএল এর প্রকল্পগুলো ভালো আছে"।
উদাহারণ দিয়ে তিনি বলেন, "জাপান থেকে গত জুনের মধ্যে পাঁচটি মেট্রো রেল আসার কথা ছিল। দেশটির সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে আমরা সরাসরি ইনস্পেকশান করতে পারিনি। এ কারণে নতুন করে টেন্ডার দিয়ে একটি জাপানী পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়ে থার্ড পার্টি ইনস্পেকশানের ব্যবস্থা করা হয়েছে"।
"এ ব্যবস্থাপনায় দুইটি ট্রেন আনা সম্ভব হয়েছে। তিনটি ট্রেন আনা যায়নি। এ নিষেধাজ্ঞা এখনও অব্যাহত আছে। এরই মধ্যে জাপানে চলমান অলিম্পিকের কারণে অনেক ধরনের বিধিনিষেধ চলছে। এ কারণে ট্রেন আসা আরও কিছুটা পেছাতে পারে"।
প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মেট্রোরেলের মালিকানায় থাকা সংস্থাটির নির্মাণ খাতে তিনটি ও সমীক্ষা খাতের দুইটিসহ মোট পাঁচ প্রকল্পে বিদেশি সহায়তা বাবদ বরাদ্দ থেকে ১৩২৮ কোটি টাকার বেশি অব্যবহার্য রয়ে গেছে।
এতে বলা হয়েছে, পাঁচ প্রকল্পে জাইকা ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ৪০৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ থেকে ব্যয় হয়েছে ২৭৪৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে অব্যবহার্য রয়ে গেছে প্রকল্প সহায়তা খাতে বরাদ্দের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
অবশ্য পাঁচ প্রকল্পে সরকারের নিজস্ব তহবিলের বরাদ্দ ৩৫৫৬.১৫ কোটি টাকার ৯৯.৮৬ শতাংশ অর্থই ব্যয় করেছে ডিএমটিসিএল।
দুই খাতে ৭২৪৫.১৫ কোটি টাকা বরাদ্দের ৬২৯৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ হিসাবে ডিএমটিসিএল এর এডিপি বাস্তবায়ন দাঁড়িয়েছে ৮২.৫৩ শতাংশে।
সভায় অংশ নেয়া একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিদেশি সহায়তা ব্যবহার করতে না পারায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো: নজরুল ইসলাম ডিএমটিসিএল এর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
সভায় সচিব বলেন, বিভাগের অন্যান্য দফতরের এডিপি বাস্তবায়ন প্রায় শতভাগের কাছাকাছি হলেও ডিএমটিসিসিএল এর ব্যর্থতার কারণে সার্বিক অগ্রগতি কম হয়েছে।
সভায় জানানো হয়, ২৫৭৪১ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সবগুলো প্রকল্পে ২২৭৪২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সব মিলিয়ে বিভাগের এডিপি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের ৮৮.২৮ শতাংশ। বিভাগের আওতায় বরাদ্দ বিদেশি সহায়তার ৮১ শতাংশ ও সরকারের নিজস্ব তহবিলের ৯১ শতাংশ ব্যয় হয়েছে।
তবে করোনার কারণে কম অগ্রাধিকার প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে কেটে নেয়া ১৫৭৬ কোটি টাকা বাদ দিলে বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি দাঁড়ায় ৯৪ শতাংশে। আর সরকারের নিজস্ব তহবিলের বাস্তবায়ন দাঁড়ায় ৯৯.৬৪ শতাংশে।
মেট্রো রেলের প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে গতি না আসায় বিভাগের সার্বিক অগ্রগতি সাড়ে পাঁচ শতাংশ কম হয়েছে বলে সভায় আক্ষেপ করেন সচিব নজরুল ইসলাম।
২০১২ সালের জুলাই থেকে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরে নেয়া এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৪ সালের জুনে। গত জুন শেষে প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৭১.৩৩ শতাংশে। বরাদ্দ বিদেশি সহায়তার শতভাগ ব্যবহার হলে এর কাজ ৭৭ শতাংশ শেষ হত।
বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন আর নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পের অনুমোদন হয়েছে ২০১৯ সালে। ৫২৫৬১ কোটি টাকার প্রকল্পে এ পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে দেড় শতাংশ।
সাভারের হেমায়েতপুর থেকে মিরপুর-১০ ও বনানী হয়ে ভাটারা পর্যন্ত ৪১২৩৮.৫৫ কোটি টাকার ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট লাইন-৫ (নর্দার্ন) প্রকল্পে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে প্রায় তিন শতাংশ।
ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, ২০৩০ সালের মধ্যে পাতাল ও উড়ালসড়ক মিলে ঢাকায় প্রায় ১২৯ কিলোমিটার মেট্রোরেলের ছয়টি লাইন নির্মাণ করতে চায় সরকার। এর মধ্যে তিনটি প্রকল্পের আওতায় ৭১.২৪ কিলোমিটার লাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
এই তিন প্রকল্প বাস্তবায়নে ১১৫৭৮৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে, যার প্রায় ৭৫ শতাংশ ঋণ দেবে জাইকা।
২০১২ সালে শুরু হওয়া উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে মতিঝিল পর্যন্ত লাইনের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৭.৬৩ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম ধাপে উত্তরা-আগারগাঁও অংশের অগ্রগতি ৮৭.৮০ শতাংশ। আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের কাজ হয়েছে ৫৯.৪৮ শতাংশ।
এই লাইনে চলাচলের জন্য ২৪ সেট ট্রেনের মধ্যে দুইটি দেশে এসেছে।
এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ও নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত মেট্রো রেল নির্মাণে বেসিক ডিজাইনের কাজ শেষে এখন ডিটেইল ডিজাইনের কাজ চলছে। প্রায় ৯৩ একর জমি অধিগ্রহণের কাজও এগিয়ে চলেছে।
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট লাইন-৫ (নর্দার্ন) প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি ও বেসিক ডিজাইনের কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
বেশকিছু কারণে অভ্যন্তরীণ উৎসের চাইতে বিদেশি সহায়তার অর্থ ছাড় পেতে বাড়তি সময় সময় লাগে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়েছে, বিদেশি সহায়তায় প্রকল্প বাস্তবায়নে পরামর্শ নিয়োগ ও ঠিকাদার নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমোদন প্রয়োজন হয়। তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতার অভাব, বিদেশি সংস্থার সাথে দর কষাকষিতে অদক্ষতাসহ বিভিন্ন কারণে সহায়তা অর্থ পেতে সময় লাগে বলেও প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে।
জানতে চাইলে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, "এটা ঠিক যে বিদেশি সহায়তার অর্থ পেতে কিছুটা বাড়তি সময় লাগে। তবে গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রকল্পের বিদেশি সহায়তার বড় একটা অংশ ছাড় না হওয়া সঙ্গত নয়"।
আইএমইডির সচিব বলেন, "সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পের অর্থ ব্যয় করতে শুধু পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রোল অনুসরণ করলেই হয়। আর বিদেশি সহায়তার অর্থ ব্যয় করতে সরকারের নীতিমালার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সংস্থার নীতিমালাও অনুসরণ করতে হয়। আর একেকটি সংস্থার একেক ধরনের নীতিমালার কারণে কিছুটা জটিলতাও থেকে যায়। এ কারণে বিদেশি সহায়তার ব্যবহার কিছুটা কম থাকে"।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, "আমাদের দেশে এমনিতেই ঠিক সময়ে কোন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার নজির খুব কম। বছরের পর বছর ঝুলে থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নে বাড়তি সময় লাগে, আবার ব্যয়ও বেড়ে যায়"।
তিনি বলেন, "কাজের যথাযথ মান নিশ্চিত না করে দাতা সংস্থাগুলোর অর্থ কখনই ছাড় হয় না। গুণগত মান নিশ্চিত করতে বিদেশি সংস্থার পক্ষ থেকে উদ্যোগ ও প্রক্রিয়ার সংখ্যাও বেশি। এ কারণে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশি সহায়তা ব্যবহারে কিছুটা অনাগ্রহ রয়েছে"।