রামু থেকে বোরহানউদ্দিন: সেই একই ছকে চলছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলোর প্রতিটি একই পদ্ধতিতে শুরু হচ্ছে। ২০১২ সাল থেকে এ যাবত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর পদ্ধতি একই-- সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করের সেখান থেকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবার মতো পোস্ট দেওয়া।
এমন চারটি ঘটনায় দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট ফেসবুক ব্যবসহারকারীরা ছিল অসতর্ক। ফলে খুবই বিপজ্জনক এক বিতর্কের জালে জড়িয়ে পড়েছেন তারা। আর এ থেকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে বিস্তৃত পরিসরে।
সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখে রামুর তরুণ উত্তম কুমার বড়ুয়ার ফেসবুক প্রোফাইলের ওয়ালে পবিত্র কোরানের অবমাননা করে একটি ইমেজ পোস্ট করা হয়। এর জেরে পরদিন কক্সবাজারের এই উপজেলায় বৌদ্ধ মন্দির ও ধর্মীয় স্থাপনাসহ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নাগরিকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার কর্মচারী উত্তম সেই সন্ধ্যায় অফিস থেকে কেবল বাড়ি ফিরেছেন। এ সময় তার ঘরের দরজায় ধাক্বা। দরজার সামনে যারা ছিলেন তারা সাবধান করে গেলেন, তার বাড়ির দিকে ধেয়ে আসছে লোকজন।
তখনই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেন উত্তম। সাত বছর পেরিয়ে গেছে। উত্তমের খবর এখনও কেউ জানে না।
পরে তদন্তে দেখা যায় যে, উত্তমের প্রোফাইলের ওয়ালে পোস্ট করা ছবিটি কারসাজি করে বানানো।
এ বিষয়ে সরকারের গঠিত তদন্ত কমিশন সিদ্ধান্ত দেয়, সেদিন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলাটি ছিল পূর্ব-পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত। এই তথ্যও উঠে আসে যে, বিতর্কিত ছবিটি উত্তমের অ্যাকাউন্টে ট্যাগ করা হয়েছিল ১৮ সেপ্টেম্বর। অথচ এ নিয়ে সহিংসতা ঘটেছে ১১ দিন পর।
কমিশন জানায়, পূর্বপ্রস্ততি নিতেই হামলার পরিকল্পকরা এই সময়টুকু নিয়েছে। তবে পুলিশের খাতায় উত্তম কুমার বড়ুয়া কিন্তু এখনও একজন অপরাধী।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনাটি ঘটে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর। সেদিন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এবং হেফাজতে ইসলামের হাজার তিনেক সদস্য উপজেলার ১৭টি মন্দির ও হিন্দু সম্পদ্রায়ের মানুষদের ৫৮টি বাড়ি লুট করেছে। সে সঙ্গে চালিয়েছে সহিংসতা।
সেখানেও একই ঘটনা। রসরাজ দাস নামের একজন স্বল্পশিক্ষিত জেলে তরুণের ফেসবুকে প্রোফাইলে পবিত্র কাবার বিকৃত ছবি প্রকাশ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। সহিংস তাণ্ডবের দিন রসরাজকে জনতার একাংশ সেদিন পিটিযেছেও অনেক।
পুলিশে পরে তদন্তে দেখতে পায়, বিকৃত ছবিটি পোস্ট করা হয়েছিল এলাকায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে। স্থানীয় একটি সাইবার শপের মালিক জাহাঙ্গীর আলম একটি ইসলামবিরোধী পোস্ট শেয়ার করে দাবি করেন যে, এটি প্রথমে রসরাজ পোস্ট করেছিলেন।
ওই ঘটনার জন্য রসরাজকে পুলিশ আটক করেছিল। আড়াই মাস জেল খেটে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পান তিনি।
২০১৬ সালেরই ১০ নভেম্বর রংপুরের ঠাকুরপাড়া গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকগুলো বড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। টিটু চন্দ্র দাস নামে এক স্থানীয় তরুণের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে মুসলিম ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবার মতো পোস্ট দেওয়া হয়েছে, এই অভিযোগে শুরু হয়েছিল ওই তাণ্ডব।
আক্রমণকারীদের ওপর পুলিশ সেদিন গুলি চালালে একজন মারা যান। আহত হন আরও অনেকে। সহিংসতাকারীরা সেদিন টিটুর বাড়িও জ্বালিয়ে দেয়।
এ ঘটনার পুলিশি তদন্তে জানা গেছে, টিটুর অ্যাকাউন্ট থেকে ধর্মীয় অবমাননামূলক কোনো পোস্টই দেওয়া হয়নি। বরং একই নামের অন্য প্রোফাইল থেকে এ ধরনের একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল।
টিটুর মা জিতেন বালা বলেন, তার ছেলে লেখাপড়া জানেন না। টিটু ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চালাতে পারেন কি না তা নিয়েও মা সন্দেহ প্রকাশ করেন। বছর দশেক আগে কাজের সন্ধানে এলাকা ছেড়েছিলেন টিটু। নারায়ণগঞ্জে থেকে কাজ করেন তিনি। তার ফেসবুক পোস্ট নিয়ে রংপুরে তার গ্রামে সহিংসতার সময় তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জেই।
এই রোববারে ভোলায় একই ধরনের ঘটনার জেরে চার জন নিহত হলেন। আহত হলেন শত শত। বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য নামের এক সংখ্যালঘু তরুণের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবার অভিযোগ এনে তার বিচারের দাবিতে স্থানীয়দের বিক্ষোভের সময় এ ঘটনা ঘটে।
পুলিশ জানিয়েছে, বিপ্লব তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকড হবার পর বোরহানউদ্দিন থানায় দুদিন আগেই একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। তারপরও পুলিশ তাকে আটক করে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিপ্লবের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুই তরুণকে গ্রেপ্তারও করেছিল। এদের একজন শরীফ যিনি বিপ্লবের কাছ থেকে টাকা চেয়েছিলেন। অন্যজন ইমন— বিপ্লবের অ্যাকাউন্ট মূলত হ্যাক করেন তিনি।