লক্ষ্মীপুরে ইটভাটায় পুড়ছে ফসলের মাটি
প্রায় ১০০ কোটি ইট তৈরিতে বছরে ১১ কোটি ঘনফুট (সিএফটি) মাটি ব্যবহার হয়। যার পুরোটাই ফসলি মাঠের মাটি। আনা হয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্মিত গ্রামীণ সড়ক দিয়ে। ফলে অস্বাভাবিকভাবে কমছে কৃষিজমি, মাটি পরিবহনে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ সড়ক এবং তৈরি হয়েছে পরিবেশগত ব্যাপক বিশৃঙ্খলা। গ্রামীণ সড়কগুলো এক বছরও টিকছে না।
ইটভাটার কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিভিত্তিক ও নদীভাঙ্গন কবলিত ছোট জেলা লক্ষ্মীপুরের চিত্র এখন এমনই।
এ জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের নোয়াখালীর আঞ্চলিক অফিসসহ কিছু প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করছেন স্থানীয়রা। সম্প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং জেলার বিভিন্ন ইটভাটার মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
স্থানীয়ভাবে তথ্য নিয়ে জানা যায়, পাঁচ উপজেলার লক্ষ্মীপুরে প্রতি বছর ইটের চাহিদা কত, এর জন্য কত ভাটার প্রয়োজন, এমন কোনো পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। তবু এ জেলায় প্রতি বছরই ইটভাটার সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১৩০।
ইটভাটার পাশে জমি থাকলে ভেঙে যায়, ফসল হয় না। ফলে ভাটার মালিকদের কাছে বাধ্য হয়ে জমির মাটি বিক্রি করেন কৃষক। মালিকেরাও জমি বিক্রি করতে বাধ্য করেন। ইটভাটার মালিকেরা প্রশাসনকে হাতে নিয়ে আরও ইটের ভাটা বৃদ্ধি করছেন- এমন অভিযোগও স্থানীয়দের। আর ভাটার মাটি পরিবহনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গ্রামের সড়কগুলো।
ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৯-এর তথ্য থেকে জানা যায়, আবাদি জমিতে কোনো ইটভাটা তৈরি করা যাবে না। পরিবহনে এলজিইডির রাস্তা ব্যবহার করা যাবে না। কাঠ পোড়ানো যাবে না। কিন্তু এর কিছুই মানছেন না ভাটার মালিকরা।
ওই আইনের উদ্দেশ্য ছিল, ২০২০ সালের মধ্যে পোড়া ইট শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। অথচ লক্ষ্মীপুরে প্রতি বছরই ইট পোড়ানোর জন্য ভাটা বাড়ছে।
জেলা প্রশাসক কার্যালয় এবং জেলা কৃষি বিভাগের সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে লক্ষ্মীপুরে ইটভাটা ছিল ৭৫টি। কিন্তু ২০২১ সালের প্রথম দিকেই সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩০-এ। অর্থাৎ বছরে বেড়েছে ১১টি। সদর উপজেলায় ৬৮টি, রামগঞ্জে ২১টি, রামগতিতে ২৩টি, কমলনগরে ১৩টি এবং রায়পুরে ৫টি ভাটা রয়েছে।
ইটভাটা স্থাপনে অনুমোদিত জমি ৩ একর হলেও ভাটার মালিকরা দখল করছেন কমপক্ষে ৯-১০ একর। সে হিসেবে ইটভাটার নিচে প্রায় ১ হাজার একর জমিও চলে গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সদর উপজেলার তেয়ারিগঞ্জ ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড আন্দারমানিক গ্রামেই রয়েছে একসঙ্গে ৯টি ইটভাটা। এ ইউনিয়নে মোট ভাটা রয়েছে ১৯টি। পুরো ইউনিয়ন কৃষিভিত্তিক এলাকা।
এছাড়া জেলার ভবানীগঞ্জ, মান্দারী, দরবেশপুর ও চর রমিজ ইউনিয়নগুলোতে ইটভাটা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। গ্রামবাসীদের মধ্যে কয়েকজন জানিয়েছে, এইসব ইউনিয়নের কোনোটাতেই অনাবাদি কোনো জমি ছিল না।
ইট তৈরিতে মাটি ও একটি ভাটায় বছরে কি পরিমাণ ইট তৈরি হয়, এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কথা হয় সদর উপজেলার একটি ভাটার ম্যানেজার সোলাইমানের সঙ্গে। তিনি জানান, ইটের আকার অনুসারে একটি কাঁচা ইট তৈরিতে মাটি লাগে ০.০৮৫ ঘনফুট। বছরের অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিটি ভাটায় কমপক্ষে গড়ে ৮ রাউন্ড ইট পোড়ানো হয়। প্রতি রাউন্ডে ১০ লাখ ইট থাকে। তার হিসেবে মতে, একেকটি ভাটায় বছরে কমপক্ষে ৭০ লাখ ইট পোড়ানো হয়। তার হিসেবে, লক্ষ্মীপুর জেলায় ১৩০টি ইটভাটার জন্য বছরে ১১ কোটি ঘনফুট মাটি প্রয়োজন, যেখান থেকে প্রায় ১০০ কোটি ইট তৈরি হয়।
ইট তৈরির কারিগর জামাল ও আরও কয়েকজন ম্যানেজার একই তথ্য দিয়েছেন।
তারা আরও জানান, ইট পোড়ানোর সংখ্যা রেজিস্ট্রার বইয়ে লেখার কথা থাকলেও ভাটার মালিকরা প্রকৃত সংখ্যা লিখেন না। কারণ জানতে চাইলে তারা জানান, ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার জন্যই প্রকৃত সংখ্যা লেখা হয় না।
সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চর মনসা গ্রামের সবজি চাষী আবদুল বাতেন জানান, তার ক্ষেতের পাশে ইটের ভাটা। রাত-দিন সেখানে পুড়ছে ইট, উড়ছে ধোঁয়া আর গ্রামের প্রতিটি কাঁচা-পাকা সড়কে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মাটিবাহী ট্রাক্টর গাড়ির ভয়ংকর শব্দ। ইটভাটার ধূলোবালি ও গাড়ির অত্যাচারে গ্রামবাসী অসহায়। প্রতিদিন প্রতিটি ভাটায় কমপক্ষে ৩০-৪০ ট্রাক্টর মাটি ঢোকে। ইটভাটা ও আশপাশের গ্রামজুড়ে যেন মাটি কাটার উৎসব।
তেয়ারিগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা সিরাজ উদ্দিন জানান, কিছু ইটের ভাটা পরিবেশ বিভাগের ছাড়পত্র, কৃষি বিভাগের ছাড়পত্র, ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র, বিএসটিআই ইত্যাদি যাবতীয় অনুমোদন নিয়ে কাগুজে বৈধ; কিন্ত এসব কাগজ নেই বা কম আছে, তারা আইনে অবৈধ। অথচ বৈধ ও অবৈধ সবারই ইট তৈরি প্রক্রিয়া, ভাটা স্থাপন এলাকা, জ্বালানি ব্যবহার, মাটি সংগ্রহ প্রক্রিয়া- সবই অবৈধ।
একই এলাকার আরিফুর রহমান অভিযোগ করেন, কোনো রকম পরিদর্শন না করেই ছাড়পত্র দিচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর, ৩ ফসলি জমিকে অনাবাধি দেখিয়ে ছাড়পত্র দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। এ রকম বৈধতা তো পুরোটাই অবৈধ।
তিনি বলেন, এভাবে পরিবেশ সদনপত্র নিয়ে কৃষি জমি, গ্রামের রাস্তাঘাট ও পরিবেশ ধ্বংস করে মানুষকে জিম্মি করা হচ্ছে।
সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের জেবি ইটভাটার এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ইটে ব্যাপক লাভ। সে কারণে কিছু লোক ইটভাটা স্থাপনে মরিয়া। তাই বছর বছর বাড়ছে ইটভাটা।
তার মতে, মাটি ব্যবসায়ী ও ভাটার মালিকরা বেশির ভাগই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত; কেউ কেউ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও। গ্রামের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরাও মাটি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত। অনেক ব্যবসায়ী জোর করে কৃষকের জমিতে ভাটা দিচ্ছেন এবং মাটি নিচ্ছেন। অনেকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সন্ত্রাসী আচরণও করছেন।
কমলনগরের তোরাবগঞ্জ গ্রামের কাদের জানান, গত বছর বাড়ির পাশের একটি ভাটার ধোঁয়ায় তার বাড়ির বহু গাছ মরে গেছে। মালিকের নামে মামলাও করেছেন তিনি। কিন্তু অফিস আদালতের সব মানুষ ভাটার মালিকের পক্ষে। ভাটার মালিকরা কাঁচা টাকা দিয়ে সব রাতারাতি ম্যানেজ করে ফেলছেন!
স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুৎফুর রহমান বলেন, 'মাটিবাহী ট্রাক্টর ও পিকআপ ভ্যানের অবাধ চলাচলের কারণে বৃদ্ধ ও শিশুরা প্রায়ই দুর্ঘটনা কবলিত হচ্ছে। সড়কে খানাখন্দ সৃষ্টি হচ্ছে।'
সম্প্রতি লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগের মাধ্যমে ফসলি জমির মাটি লুট এবং ইটভাটা মালিক ও মাটির দালালদের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি তুলে ধরেন আহমেদ জাকারিয়া নামে এক ভুক্তভোগী। এছাড়াও স্থানীয় জনগণ বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন, কৃষি কার্ডধারী কৃষকবৃন্দদের ব্যানারে মানববন্ধন করেছেন, শোভাযাত্রা করেছেন; কিন্তু কোনো কিছুতে কোনো কাজ হয়নি।
পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইসমাইল হোসেন সবুজ বলেন, 'ইটভাটায় কেবল মাটি ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এখানে বাধ্যতামূলক শ্রম আছে, দাদনভিত্তিক শ্রম ও শিশুশ্রম আছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই পোড়ানো ইট ব্যবহার করে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে দ্রুত পোড়া ইটের বিকল্প ব্যবহারে ফিরে যেতে হবে।'
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের লক্ষ্মীপুর জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শাহ আলম পাটোয়ারী অভিযোগ করেন, গ্রামীণ সড়কগুলো ইট ভাটার কারণে টেকানো যাচ্ছে না। অথচ স্থানীয় সরকার বিভাগের কোনো সড়কের পাশে ইটভাটা স্থাপনের নিয়ম নেই।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা কীভাবে এটা বন্ধ করব? ইটভাটা অনুমোদনের জন্য যে কমিটি আছে, তাতে তো স্থানীয় সরকার বিভাগের কেউ নেই!'
লক্ষ্মীপুর জেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অফিস নেই। জেলার পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখাশোনা করে পরিবেশ অধিদপ্তরের নোয়াখালী জেলা অফিস। সরেজমিন পরিদর্শন না করে কিংবা নীতিমালা না দেখে পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নোয়াখালী পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কোনো তথ্য জানাতে রাজি হননি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক তানজিদ তারেক বলেন, 'সব কিছু সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক জানেন।'
'আমরা জেলা প্রশাসককে তথ্য দিই; অন্য কাউকে তথ্য দিতে বাধ্য নই,' বলেন ওই কর্মকর্তা।
বৈধ কাগজপত্র নিয়ে অবৈধ্য ইটভাটার বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন আখন্দ বলেন, 'আমি জেলায় যোগদান করেই ইটভাটার নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি। সেটা অব্যাহত থাকবে।'
তিনি আরও জানান, জেলা প্রশাসক প্রতিটি ইটভাটার জন্য ৩ একর জমি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর বাইরে কোনো অবস্থায়ই বেশি জমি ইটভাটায় ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। বাকি অনিয়মগুলোও দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।