শয্যা সংকট: সিঁড়িতে, বারান্দায় শুয়েই চিকিৎসা নিতে হয় হৃদরোগ হাসপাতালের রোগীদের
বুকে ব্যথা নিয়ে চারদিন আগে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিভিডি) আসেন চাঁদপুরের ইউনুস তালুকদার (৫৬)। হার্টে ব্লক ধরা পড়ায় সেদিনই তাকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। ভর্তিও হন তিনি, তবে চারদিনেও অসুস্থ ইউনুস হাসপাতালে থাকার জন্য কোনও শয্যা পাননি। অগত্যা হাসপাতালের কার্ডিওলজি পুরুষ ওয়ার্ডের সামনের বারান্দায় খালি জায়গায় বিছানা পেতেই থাকতে হচ্ছে থাকে, তার চিকিৎসাও চলছে সেখানে।
ইউনুস তালুকদারের ছেলে শাহাদাত বলেন, চারদিন ধরে মেঝেতেই আছি। এখানেই ডাক্তার দেখে যাচ্ছে। ডাক্তার এনজিওগ্রাম করাতে বলেছে। এনজিওগ্রাম করালে দুই সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হবে। তখনো বেড পাওয়া যাবে কি না তা এখনো জানি না।
ইউনুস তালুকদারের মত বুকে ব্যথা নিয়ে একইদিন এনআইসিভিডির (করোনারি কেয়ার ইউনিট) সিসিইউতে ভর্তি হন নরসিংদীর আব্দুল লতিফ (৬০)। তার অবস্থার উন্নতি হলে একদিন পরই সিসিইউ থেকে ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয় তাকে। কিন্তু ওয়ার্ড এমনকি বারান্দায়ও জায়গা খালি পাননি তিনি। তাই পুরুষ ওয়ার্ডের সামনের সিঁড়িতে স্বামীর জন্য বিছানা পেতেছেন আব্দুল লতিফের স্ত্রী বেবি আক্তার।
বেবি আক্তার বলেন, ডাক্তাররা চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। রোগীকে ওষুধ ও ইনজেকশ দিয়েছেন। কিন্তু কোন বেডের ব্যবস্থা করতে পারছেন না।
শয্যা সংকটে দুর্ভোগে রোগীরা
প্রতিদিন শতাধিক হৃদরোগী এনআইসিভিডির বারান্দা, সিঁড়ি, চিকিৎসকদের চেম্বারের সামনেসহ বিভিন্ন খালি জায়গায় আশ্রয় নেন। এতে করে রোগীদের সেবা দিতেও বেগ পেতে হয় চিকিৎসক-নার্সদের।
চিকিৎসকেরা জানান, মেঝেতে থাকায় রোগীরা ঠান্ডাসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভোগে। বিভিন্ন জায়গায় রোগীরা ছড়িয়ে থাকায় তাদের ঠিকমত তদারকি করাও কঠিন হয়ে যায়।
৪১৪ শয্যার এ হাসপাতালে প্রতিদিন অন্তত ১ হাজার রোগী ভর্তি থাকে। দেশের বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর মধ্যে বেড অকুপেন্সি রেট সবচেয়ে বেশি এ হাসপাতালে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিন ২০১৮ এর তথ্যমতে, এ হাসপাতালে বেড অকুপেন্সি রেট প্রায় ১৯১.৫ শতাংশ।
এনআইসিভিডির পরিচালক অধ্যাপক আফজালুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “আমরা কোন রোগীকে ফিরিয়ে দেই না। আমরা যদি না বলি তাহলে রোগীরা যাবে কোথায়? আমাদের হাসপাতালে সিসিইউতে ফ্লোরিং করা হয়, বাইরের কোন হাসপাতালে তা হয়না। কিন্তু উপায় তো নেই। রোগীকে তো রাস্তায় রাখতে পারিনা। ফ্লোরে রেখে হয়তো শতভাগ সেবা দেয়া যাবেনা কিন্তু রোগী চিকিৎসা পায়।”
তিনি আরও বলেন, “রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হাসপাতালের অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হয়নি। আগে থেকে যদি অবকাঠামোর উন্নয়ন হতো তাহলে এখন রোগীদের এতো ভোগান্তি হতো না। ফ্লোরে রেখে রোগীর চিকিৎসা দিবো নাকি রোগীকে রাস্তায় ফেলে দিবো? যতদিন পর্যন্ত আমাদের নতুন অবকাঠামো না হয় ততোদিন রোগীকে ফ্লোরে রেখেই চিকিৎসা দিবো। এতে রোগীর কষ্ট হবে কিন্তু সেবা তো পাবে। সেবার মান শতভাগ না হলেও সেবা দিতে পারবো। আমাদের যখন ১২০০ বেড হবে তখন আমরা বলতে পারবো যে মেঝেতে রোগী রাখবো না।”
বিশেষায়িত এ হাসপাতালে লাইফ সেভিং ওষুধ বিনামূল্যে দেয়া হয়। এনাসেপারি ইনজেকশন ফ্রি পায়। গরিব, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অক্সিজেন, ভাল্ব ফ্রি।
হৃদরোগী বাড়ছে
দেশে হৃদরোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, দেশে প্রতিবছর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ৩০ শতাংশ মানুষ।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “জীবন যাত্রা ও খাদ্যাভাসের পরিবর্তনের কারণে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন ধরণের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ বাড়ছে।”
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে হাসপাতালটিতে ৫৬৮টি ওপেন হার্ট সার্জারি ও ১৯৪৯টি ভাসকুলার সার্জারি হয়েছে। করোনারি এনজিওগ্রাম, কার্ডিয়াক ক্যাথ, পিসিআইসহ ক্যাথল্যাব প্রসিডিউর হয়েছে ১০ হাজার ৫৭৪টি।
২০১৮ সালে হাসপাতালের বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছেন ২ লাখ ৮৩ হাজার ৬০৫ জন।