শীত যতই ঘনিয়ে আসছে, বাংলাদেশে আবারও নিপাহ ভাইরাসের প্রদুর্ভাবের শঙ্কা বাড়ছে
লালমনিরহাট জেলায় অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের এক সন্ধ্যা। তাপসী ঘোষ নামে এক মাকে দেখা যায় তার সন্তানদের ফ্রেমে বাঁধানো একটি ছবি থেকে ধুলো পরিষ্কার করতে। তাপসীর দুই সন্তানই নিপাহ ভাইরাসে মারা গেছে। এখন এই ছবিতে কেবলই তাদের স্মৃতি। দশ বছর আগের কথা স্মরণ করতে গিয়ে তাপসীর দুচোখে নামে অশ্রুর বান।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাপসী ঘোষের ছেলে অরণ্য কুমার (৮) প্রথম নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিল। দুই দিন পর তার বোন অনন্যাও (৪) এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়। তাপসীর ধারণা, তার দুই সন্তানই সকাল বেলায় বাড়ির উঠোনের পেয়ারা গাছের নিচ থেকে কুড়িয়ে পেয়ারা খেয়েছিল, যা রাতে বাদুড়ে খেয়েছিল। অথবা তার সন্তানেরা বন্ধুদের সঙ্গে কাঁচা খেজুরের রস পান করেছিল।
এরপর থেকে সাবেক এনজিওকর্মী তাপসী এবং চর ধুবনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অশোক কুমার ঘোষ মৃত সন্তানদের স্মৃতি আঁকড়ে নিঃসন্তান অবস্থায় লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার বন্দর এলাকায় বসবাস করছেন। প্রসঙ্গত, অনন্যার জন্মের পর তাপসী স্থায়ীভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন।
তাপসী বলেন, 'আমার বাচ্চারা না বুঝে বাদুড়ের অর্ধেক খাওয়া ফল খেয়েছে। আমি চাই না অন্য কোনো বাবা-মাকে এমন যন্ত্রণা সহ্য করতে হোক। এটি যাতে না ঘটে তার জন্য সরকারের আরও বেশি কাজ করা উচিত।'
তাপসী এবং অশোকই একমাত্র বাবা-মা নন যারা নিপাহ-এর কাছে তাদের সন্তানদের হারিয়েছেন। ওই বছর একই মাসে, ওই এলাকার এসএস হাই স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সুদীপ্ত সরকার দ্বীপ (১২) মারাত্মক এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যায়। সুদীপ্তও ছিল তার পিতা সুবল চন্দ্র সরকারের একমাত্র পুত্র।
সেই ভয়াল দিনের কথা স্মরণ করে সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, সুদীপ্ত স্কুলে তার বন্ধুদের সাথে স্থানীয় বাজার থেকে কাঁচা খেজুরের রস পান করেছিল। তারপর তার জ্বর, শরীর ব্যথা ও মাথাব্যথা হয়।
সুবলের ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যুতে আশপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণে তার পরিবার সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে যায়, কেউ তাদের সঙ্গে মেলামেশা করত না। নিকটাত্মীয়রাও দূরে সরে যায়, যা তাদের যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে তোলে।
পেশায় ডাক্তার সুবল সরকার বলেন, 'যখন আমার ছেলে নিপাহ ভাইরাসে মারা গিয়েছিল, তখন ভয়ের কারণে এলাকাটি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছিল। আমাদের নিকটাত্মীয়রা সংক্রমণের উদ্বেগ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। কেউ আমাদের সাথে কথা বলেনি বা আমাদের খোঁজখবর নেয়নি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা আমার ছেলের মৃতদেহকে স্বাভাবিকভাবে দাহ করতে পারিনি। আমি নিজে একটি ঠেলা গাড়িতে করে আমার ছেলের মরদেহ একাই শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিলাম। নিজেই তাকে দাহ করার ব্যবস্থা করেছিলাম। আমাদের প্রতিবেশীরা অন্তত দুই বছর ধরে আমাদের এড়িয়ে চলেছিল। তাই শীতকাল আমাদের কাছে আতঙ্ক নিয়ে আবির্ভূত হয়।'
লালমনিরহাট জেলায় এ পর্যন্ত অন্তত ৩০ জন নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। ২০১১ সালে এই জেলায় এটি মহামারিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। সে সময় এক সপ্তাহে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয় এ ভাইরাসে।
বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাস
১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় প্রথম মত নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। এর চার বছর পর ২০০১ সালে বাংলাদেশে প্রথম ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্ত হয়। আইসিডিডিআরবি-এর সংক্রামক রোগ বিভাগের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৩২২ জনের শরীরে নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ২২৯ জন সংক্রমণে মারা গেছে। এই হিসাবে, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তদের ৭১ দশমিক ১ শতাংশ রোগীই মারা গেছেন।
বেশ কয়েকজন গবেষক আশঙ্কা করছেন, নিপাহ ভাইরাস (NiV) কোভিড-১৯-এর পর পরবর্তী মহামারির কারণ হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউওএইচও) নিপাহ ভাইরাসকে মহামারির সম্ভাব্য দশটি ভাইরাসের একটি হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছে।
এখন পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসের দুইটি ধরন পাওয়া গেছে। একটি হলো বাংলাদেশি ধরন এবং অপরটি মালয়েশিয়ান ধরন।
'প্যাথোজেনিক ডিফারেন্সস বিটুইন বাংলাদেশ অ্যান্ড মালয়েশিয়া স্ট্রেইনস ইন প্রাইমেটস: ইমপ্লিকেশনস ফর অ্যান্টিবডি থেরাপি' শিরোনামের এক গবেষণায় বাংলাদেশি ধরন বা স্ট্রেইনকে মালয়েশিয়ান ধরনের চেয়ে বেশি সংক্রামক বলে দাবি করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৩২টিতে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। সর্বাধিক সংখ্যক ৩০ জনের বেশি সংক্রমিত রোগী পাওয়া গেছে ফরিদপুর জেলায়। ফরিদপুরে ২০০৪ ও ২০১১ সালে এই ভাইরাসের মহামারি দেখা দেয়।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমিত জেলা হলো লালমনিরহাট। লালমনিরহাট, নওগাঁ ও রাজবাড়ীতে ২১ থেকে ৩০ জন সংক্রমিত রোগী পাওয়া গেছে। এই জেলাগুলিতে একাধিকবার ভাইরাসের মহামারি দেখা দিয়েছিল।
নয়টি জেলায় ১১ থেকে ২০ জন, অন্য সাতটি জেলায় ৬ থেকে ১০ জন সংক্রামিত রোগী এবং আরো নয়টি জেলায় একজন করে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাদুড় ও শূকর থেকে মানুষের মধ্যে নিপাহ ভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
শীতকালীন খেজুরের রসে প্রাণঘাতী ভাইরাস
বাংলাদেশে খেজুরের রস ঐতিহ্যগতভাবে পানীয় হিসেবে সারা দেশে খুব জনপ্রিয়। লোকে অপরিশোধিত বা কাঁচা রস পান করে, যা খেজুর গাছ থেকে রাতারাতি সংগ্রহ করা হয়। মানুষের মতোই প্রায়ই রাতে বাদুর খেজুর গাছে যায় এবং গাছে তাদের লালা বা শরীরের তরল ফেলে, যা কাঁচা রস বিক্রেতাদের সংগ্রহ করা রসে মিশে যায়। বাদুড় যেহেতু নিপাহ ভাইরাসের একটি প্রাকৃতিক আধার—মানে ভাইরাস বাদুরের দেহে স্বাভাবিকভাবেই বাস করে, তাই লালাও ভাইরাস ধারণ করতে পারে। কাঁচা রসে বাদুড়ের লালা বা নিপাহ ভাইরাসের সম্ভাব্য অস্তিত্ব সম্পর্কে বিক্রেতা এবং পানকারীরা অবিদিত থাকেন বলে, তারা এটি অবাধে পান করেন। যা ভাইরাসের সংক্রমণকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
আইসিডিডিআরবির সহকারী বিজ্ঞানী ও উপ-প্রকল্প সমন্বয়কারী ডা. সৈয়দ মঈনুদ্দিন সাত্তার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এটি আমাদের সময়ের সবচেয়ে মারাত্মক সংক্রামক রোগগুলির মধ্যে একটি এবং দুর্ভাগ্যবশত এটি আমাদের দেশে স্থানীয়।'
তিনি আরও বলেন, 'এটি বাদুড় থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, যা একটি স্পিলওভার ইভেন্ট হিসাবে বিবেচিত হয়। এই স্পিলওভারের সবচেয়ে সাধারণ মাধ্যম হলো কাঁচা খেজুরের রস। যা বাদুড়ের লালা, প্রস্রাব বা মল দ্বারা দূষিত থাকে। রোগটি একজন সংক্রমিত ব্যক্তির থেকেও ছড়াতে পারে। যেমন—লালা, রক্ত, প্রস্রাব, মল ইত্যাদির মাধ্যমে। এছাড়াও, সংক্রমিত গৃহপালিত পশুদের মাধ্যমে মানুষের সংক্রমণের ইতিহাস রয়েছে।'
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে, লালমনিরহাট মাটিভাঙ্গার শারমিন জামান মেরি (৩২) একটি বরই গাছের নিচ থেকে বরই কুড়িয়ে খেয়ে নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হন। তিন সপ্তাহের চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন, কিন্তু সংক্রমণ তার জীবনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
শারমিন জামান বলেন, 'আমার নিয়মিত মাথাব্যথা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট এবং নিয়মিত হালকা জ্বর থাকে।
'বাদুড়রা প্রতি রাতেই বরই গাছে আসতো, আমি সবসময় সকালে কিছু পাকা বরই খেতাম শখ করে। একদিন ফল খাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার স্বামী আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান, সেখানে আমার নিপাহ ধরা পড়ে।'
আইসিডিডিআরবির ডা. সাত্তারের মতে, প্রাথমিক সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠার পর প্রায় সব ব্যক্তিই স্নায়ুবিক সমস্যায় ভুগছেন। যেমন—সূক্ষ্ম নড়াচড়া করতে অসুবিধা, ভারসাম্য বজায় রাখতে অসুবিধা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, আংশিক বা সম্পূর্ণ পক্ষাঘাত। এছাড়াও চক্ষু-সংক্রান্ত জটিলতা, যেমন ফটোফোবিয়া এবং সেইসাথে হালকা থেকে গুরুতর দৃষ্টিশক্তির প্রতিবন্ধকতা। এই সবগুলো তাদের মানসিক স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার মান, উপার্জন করার ক্ষমতা এবং একটি স্থিতিশীল সামাজিক অবস্থা বজায় রাখার উপর আমূল প্রভাব ফেলে।
স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি, নিপাহ থেকে বেঁচে যাওয়া এবং মৃত রোগীদের পরিবারের সদস্যরাও গুরুতর সামাজিক কলঙ্কের সম্মুখীন হন, এমনকি রোগটিতে সংক্রমিত না হলেও। এমনকি স্বজনরাও সংক্রমণের ভয়ে তাদের এড়িয়ে চলেন।
নিপাহ থেকে বেঁচে যাওয়া শারমিন জামান মেরি জানিয়েছেন, তার অনেক আত্মীয় তার পরিবারকে দীর্ঘদিন এড়িয়ে চলেছেন। শারমিন বলেন, 'এখনো কেউ আমার নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের কথা শুনলে আমাকে অবজ্ঞা করে।'
লালমনিরহাটের সুবল চন্দ্র সরকারের স্থানীয় বাজারে একটি ওষুধের দোকান রয়েছে। তিনি জানান, সামাজিক কলঙ্ক তার জন্য অর্থনৈতিক কষ্টের কারণ হয়েছিল।
তিনি বলেন, 'আমার ছেলে নিপাহতে মারা যাওয়ার পর আমি আমার সমস্ত গ্রাহক হারিয়েছিলাম।'
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ
নিপাহ ভাইরাস থেকে বাঁচতে বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ হলো, এই রোগটি সম্পর্কে জনগণের আরও সতর্ক হওয়া উচিত এবং সংক্রমণের পরিচিত মাধ্যমগুলো এড়ানো উচিত। যেমন—কাঁচা খেজুরের রস না খাওয়া, জীবিত বা মৃত সংক্রমিত প্রাণীদের সংস্পর্শে না আসা এবং বাদুড় বা পাখির খাওয়া ফল না খাওয়া। এখনো নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ওষুধ বা টিকা তৈরি না হওয়ায় জনগনকে আরও সচেতন হতে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইসিডিডিআরবির ডাঃ সৈয়দ মঈনুদ্দিন সাত্তার বলেন, 'বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি হয় ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত সময়ে। এই সময়টা কাঁচা খেজুরের রস সংগ্রহের মৌসুম। তাই কাঁচা খেজুরের রস খাওয়ার ইতিহাস আছে এমন রোগীদের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে দেশের স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং ডাক্তারদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত।'
'আমাদের আনুষ্ঠানিক বড় ধরনের সচেতনতামূলক প্রচারাভিযানের কর্মসূচি নেই। স্থানীয় হাসপাতালগুলো শীতকালে চিকিৎসার জন্য আসা রোগীদের এসব বিষয়ে জানান,' বলেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে সংক্রমিত জেলা ফরিদপুর জেলার সিভিল সার্জন ডা. সিদ্দিকুর রহমান।
লালমনিরহাট জেলার সিভিল সার্জন ডা. নির্মেলেন্দু রায় ভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে একটি বড় ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, 'সঠিক সচেতনতা ও প্রচারের অভাবে অনেক লোক সংক্রামিত হচ্ছে।'
- আর্থ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের সহযোগিতায় প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে।