সাগরের পানিতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, চিংড়ি হ্যাচারিতে দু’মাসে ক্ষতি শত কোটি টাকা
বঙ্গোপসাগরের পানিতে হঠাৎ ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বেড়েছে। ফলে পোনা উৎপাদনে সাগরের পানি ব্যবহার করা কক্সবাজার ও সাতক্ষীরার চিংড়ি হ্যাচারিগুলোতেও শুরু হয়েছে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ। এতে গত দু'মাসে ব্যাকটেরিয়ায় মড়কের কবলে পড়ে ৫৯টি হ্যাচারিতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় শত কোটি টাকা মূল্যের পোনা। হ্যাচারি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট রিসার্চ সেন্টারগুলো আগেভাগেই সতর্ক করলে হয়তো এ ধরণের ক্ষতির মুখে পড়তে হতো না।
লোকসানের কারণে এই মুর্হূতে পোনা উৎপাদনে যেতে শংকিত রয়েছেন হ্যাচারিরা মালিকরা। আবার ঘের চাষিদের কাছ থেকে পোনার চাহিদা থাকা স্বত্ত্বেও পোনা দিতে না পারায় রপ্তানিতেও প্রভাব পড়বে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
কক্সবাজার সোনারপাড়াস্থ 'রাইসা ও মেরিগোল্ড হ্যাচারি'র ভাড়াটিয়া এবং সাতক্ষীরার 'কক্সবাজার হ্যাচারি'র মালিক ও প্রধান টেকনিশিয়ান হারুন-অর-রশীদ (৩৯) বলেন, 'কক্সবাজার উপকূলে ৩২টি এবং সাতক্ষীরায় রয়েছে ২৭টি চিংড়ি পোনা হ্যাচারি। পোনা উৎপাদনে হ্যাচারিগুলোতে প্রবেশ করানো হয় সাগরের পানি, যা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে মা চিংড়ি থেকে উৎপাদন করা হয় লাখ লাখ চিংড়ি পোনা। একবার প্রোডাকশনে (উৎপাদন) গেলে ১ থেকে আড়াই কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয় একেকটি হ্যাচারিকে। গত দুটি চালানেই উৎপাদিত চিংড়ি পোনায় মড়কের 'খড়গ' পড়েছে। এতে কোন কোন হ্যাচারি পুরো এবং কোন হ্যাচারি অর্ধেক ক্ষতির মুখে পড়ে। সে হিসেবে হ্যাচারিগুলো গত দু'চালানে প্রায় শত কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছে।
তিনি আরো বলেন, 'জানুয়ারি থেকে হ্যাচারিগুলোতে চিংড়ি পোনা উৎপাদনের মৌসুম শুরু হয়েছে। প্রথম সার্কেল ভালভাবে পোনা উৎপাদনের পর সাতক্ষীরা, যশোর ও খুলনা অঞ্চলে সরবরাহ দেয়া হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ দ্বিতীয় ও তৃতীয় সার্কেলে প্রোডাকশনের জন্য সংগ্রহ করা সাগরের পানিতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি মিলে। এতে হ্যাচারিগুলোতে উৎপাদিত চিংড়ি পোনা মড়কের কবলে পড়েছে। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে লাখ লাখ পোনা। মড়কের কারণে পোনা উৎপাদনে যেতে আতঙ্কে রয়েছে হ্যাচারিগুলো'।
টেকনিশিয়ান হারুনের মতে, হ্যাচারি শিল্পকে ভোগানো অণুজীবটি হলো 'লুমিনাস ব্যাকটেরিয়া'। একে 'এলবি' হিসেবে চেনে হ্যাচারি সংশ্লিষ্টরা। এই ব্যাকটেরিয়া খুবই মারাত্মক। এর প্রাদুর্ভাব হ্যাচারিতে হানা দিলে শতভাগ পোনা নষ্ট হয়ে যায়। দীর্ঘ বৃষ্টিহীনতায় সাগরের পানিতে লবণের মাত্রা বেশি হলে এ ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বাড়ে। তখন শত চেষ্টা করেও পোনা টেকানো যায় না। যদি ভারী বৃষ্টিপাত হয়, আর সাগরের পানিতে লবণাক্ততা স্বাভাবিক হয়ে আসে, তবে এ ব্যাকটেরিয়া আপনাআপনি চলে যাবে।
সোনারপাড়ায় বলাকা হ্যাচারির কর্মী ইমাম হাসান বলেন, 'তৃতীয় সার্কেলে পোনা উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ হয়েছে ২ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে সব পোনা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বিনিয়োগের সম্পূর্ণ টাকা লোকসান হয়েছে। ফলে, চলতি সার্কেলে পোনা উৎপাদনে যেতে সাহস পাচ্ছি না। গত বছরও করোনার কারণে লোকসান গুনতে হয়েছে। এবার নতুন করে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ। সবকিছু মিলিয়ে দিশেহারা অবস্থা'।
শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সেব) এর মহাসচিব মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম বলেন, 'লুমিনাস ব্যাকটেরিয়া থেকে বাঁচতে অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়ে থাকে হ্যাচারিগুলো। কিন্তু ব্যাপক হারে ছড়িয়ে গেলে তখন পদক্ষেপগুলো আর কাজে আসে না। এফ.আর.আই ও মেরিন রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামে সরকারের দুটি রিসার্চ সেন্টার আছে। উপকূলে কী ধরনের ব্যাকটেরিয়া আছে, কখন কী ধরনের ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে, তা হ্যাচারিগুলোকে আগেভাগেই জানিয়ে দিলে তখন হ্যাচারিগুলোর পদক্ষেপ নিতে সহজ হয়। কোনো ধরনের তথ্য না পাওয়ায় ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে চিংড়ি পোনা মড়কে পড়েছে। এতে হ্যাচারি শিল্প ধুঁকছে'।
নজিবুল ইসলাম আরো বলেন, 'সাগরের পানিতে ব্যাকটেরিয়ার দূষণ প্রাকৃতিকভাবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত চিংড়ি পোনা উৎপাদন সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে উপকূলের ৫৯টি হ্যাচারিতে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে অর্ধশতাধিক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভারী বৃষ্টির পর অতিরিক্ত তাপমাত্রা কমে গেলে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ চলে যাবে। তারপর আবার আগের মতো ভালভাবে চিংড়ি পোনা উৎপাদন করতে পারব বলে আশা করছি'।
সেব মহাসচিব নজিবের মতে, এই সময়টাতে চাষিদের চিংড়ি পোনার চাহিদাটা বেশি। এখন যেহেতু চিংড়ি পোনা উৎপাদন করা যাচ্ছে না, সেহেতু চাষিরাও ঘেরে পোনা ফেলতে পারছে না। এ কারণে চিংড়ি উৎপাদনে জাতীয়ভাবে ঘাটতি ও রপ্তানিতেও প্রভাব পড়তে পারে।
সেব-এর তথ্য মতে, বড় ২০টি , মাঝারি ১৫টি এবং ছোট ২৪টি মিলিয়ে মোট ৫৯টি হ্যাচারি প্রতি মৌসুমে ৬ সার্কেলে প্রায় ২ হাজার ১৬০ কোটি পোনা উৎপাদন করে। আর চলমান তিন সার্কেলে উৎপাদন হওয়ার কথা প্রায় ৮০০ কোটি চিংড়ি পোনা। কিন্তু গত ৩ সার্কেলে সাতক্ষীরা, যশোর ও খুলনা অঞ্চলে সরবরাহ দেয়া সম্ভব হয়েছে মাত্র ২০০ কোটি পোনা।