সামাজিক হেনস্তার ভয়ে করোনার নমুনা দিতে অনীহা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলা সদরের রাধানগর এলাকার বাসিন্দা ফজলে রাব্বী (৩৬)। পেশায় ব্যবসায়ী। গত ৯ জুন রাতে প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হন তিনি। সঙ্গে সর্দি-কাশিতে শরীর আরও দুর্বল হয়ে পড়ে তার। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গেলে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করতে বলা হবে- সে ভয়ে হাসপাতালে যাননি তিনি।
যদি করোনাভাইরাস 'পজিটিভ' হয় তাহলে তার বাড়ি লকডাউন করে দেওয়া হবে এবং পরিবারের লোকজন সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হবেন- এমনটা ভেবে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য তিনি নমুনা দেননি।
ফজলে রাব্বী বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই দেখছি কেউ আক্রান্ত হলে প্রশাসন গিয়ে তার বাড়ি লকডাউন করে দিচ্ছে। এতে করে আক্রান্তের পরিবারটি একঘরে হয়ে পড়ে। প্রতিবেশিরাও তাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করে। আমাদের উপজেলা সদরেও কয়েকটি বাড়ি লকডাউন করে দিয়েছিল প্রশাসন। ফলে আক্রান্তের জন্য পুরো পরিবারকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়।
তিনি আরও বলেন, জ্বর একবার কমে, আরেকবার বাড়ে। তবুও পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে নমুনা দেইনি। বাড়িতে আলাদা রুমে অবস্থান করছি। ফার্মেসি থেকে সাধারণ জ্বর ও সর্দি-কাশির ওষুধ এনে সেবন করছি। পাশাপাশি গরম পানির ভাপ নিচ্ছি; একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠেছি।
ফজলে রাব্বীর মতো অনেকেই সামাজিকভাবে হেনস্তা হওয়ার ভয়ে করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও নমুনা দিচ্ছেন না। অনেকে হাসপাতালে না গিয়ে বাড়িতে বসেই ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে সেবন করছেন। ফলশ্রুতিতে চিকিৎসা না নিয়ে মারা যাচ্ছেন কেউ কেউ।
এ ছাড়াও করোনার উপসর্গ আছে- এমন ব্যক্তিরা নমুনা না দেওয়ায় তাদের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। বাড়িতে নেওয়া চিকিৎসায় কেউ কেউ সুস্থ হয়ে উঠলেও তাদের মাধ্যমেও সংক্রমণ ছড়ানোর শঙ্কা রয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় করোনার উপসর্গ নিয়ে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিদিনই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। গত ২০ জুন পর্যন্ত জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৩৩ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ছয়জন। বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতাল ছাড়াও জেলার নয়টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
জ্বর, কাশি, গলাব্যাথা ও শ্বাসকষ্ট হলেই করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু অনেকে উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সামাজিকভাবে হেনস্তা হওয়ার ভয়ে নমুনা পরীক্ষা করান না। এতে করে তাদের মাধ্যমে অন্য কেউ আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আবার অনেকেই আছেন, যাদের উপসর্গ না থাকলেও সন্দেহমুক্ত হওয়ার জন্য নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন।
শরীরে করোনাভাইরাসের উপসর্গ বহন করছেন, অথচ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিচ্ছেন না- এমন বেশ কয়েকজনর সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। তবে তারা শর্ত দিয়েছেন নাম-পরিচয় গোপন রাখার। শুধুমাত্র সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে নমুনা দিচ্ছেন না তারা।
জেলার নবীনগর উপজেলার লাউর ফতেহপুর গ্রামের এক তরুণ গত ১০/১২ দিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। এ ছাড়াও সারা শরীরে ব্যাথাও আছে তার। কিন্তু তিনিও করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনা দেননি।
তিনি জানান, ওষুধ সেবনের পাশাপাশি গরম পানির ভাপ নিচ্ছেন। এ ছাড়া লেবুর শরবত এবং আদা, দারুচিনি ও লবঙ্গ দিয়ে নিয়মিত রং চা খাচ্ছেন। নিজে ভয় পাওয়ার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য কাউকে না জানিয়ে বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। এতে করে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করেন ওই তরুণ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মধ্যপাড়া মহল্লার এক তরুণ জানান, তিনি নমুনা দেননি, অথচ গুজব ছড়ানো হয়েছে তার করোনাভাইরাস 'পজিটিভ' এসেছে। পরবর্তীকালে মহল্লার ছেলেরা তার বাড়িতে গিয়ে তাকে হেনস্তা করেন। পরিবারের সবাইকে বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করেন। এতে করে তার পরিবারের লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর দফতর) আবু সাঈদ বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এখন লকডাউন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তবে আক্রান্তদের বাড়ির আশাপাশের মানুষজনরা যেন আক্রান্তের পরিবারের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করে তাদের পাশে দাঁড়ান, সেজন্য আমরা সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করে যাচ্ছি। আক্রান্তদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে প্রতিবেশীরা যেন সহযোগিতা করেন; সেজন্য আমরা কাজ করছি।
''নমুনা না দেওয়ার ফলে উপসর্গ থাকা ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদেরও ঝুঁকি রয়েছে। আমাদের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করার কাজও করছেন। এই দুর্যোগে সবাইকে আগে সচেতন হতে হবে।'' বললেন সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ একরাম।
তিনি আরও বলেন, মানবিক দিক বিবেচনা করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারের সঙ্গে ভালো আচরণ করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে সবার সহযোগিতা করতে হবে।