সিনহা হত্যা মামলা: তৃতীয় দফায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু
কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারকার্যের তৃতীয় দফা সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর দিনে তিনজনের সাক্ষ্য ও জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে।
তৃতীয় দফার প্রথম দিন ৪ জন সাক্ষী হাজিরা দিতে আসেন। এর মধ্যে মো. আবদুল হাকিম, ফিরোজ মাহমুদ, শওকত আলীর সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন করা হয়। আবদুল হামিদকে দিয়ে ১০টা ২০ মিনিটে সাক্ষ্য শুরু হয় বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম।
তিনি বলেন, মামলার তৃতীয় দফার সাক্ষ্যগ্রহণ চলবে ২০, ২১, ২২ সেপ্টেম্বর। এ তিন দিনে একাধিক সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করার উদ্যোগ রয়েছে।
"প্রথমদিন ৪ সাক্ষির হাজিরা দিয়েছি। তাদের মাঝে তিনজনের সাক্ষ্য সম্পন্ন হয়। বাকি থাকেন সার্জেন্ট মোঃ আয়ুব আলী। আসামি পক্ষের আইনজীবীদের সহযোগিতা পেলে এভাবে প্রতিদিন একাধিক সাক্ষী সম্পন্ন করার প্রচেষ্টা থাকবে। সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) শুরু হওয়া স্বাক্ষ্য ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে।"
৮ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফা সাক্ষ্য গ্রহণের শেষ দিনে ৬ষ্ঠ সাক্ষীর জেরা শেষে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল তৃতীয় দফার সাক্ষের এ আদেশ দেন।
আদালত সূত্র জানায়, অন্য দিনের মতো সোমবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে মামলার আসামী সাবেক ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ ১৫ আসামীকে কারাগার হতে আদালতে আনা হয়। দ্বিতীয় দফার চতুর্থ দিনের জন্য হাফেজ মৌলানা শহিদুল ইসলামের সাক্ষ্যের হাজিরা দেয়া হয়। প্রথম দিন ৬জনের এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে ৩ জনের হাজিরা দেয়া হলেও মাত্র একজন করেই সাক্ষ্য ও জেরা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। শেষদিন হিসেবে বুধবার একজনের হাজিরা দেয়া হয়। কিন্তু বেলা আড়াইটার দিকে ৬ষ্ঠ সাক্ষীর জেরা সম্পন্ন হওয়ায় বাকি দু'সাক্ষীকে আদালতে হাজির করেন সরকারি কৌঁসুলি। কিন্তু বিচারক আদালত মূলতবি ঘোষণা করায় এ দিন আর সাক্ষ্য নেয়া হয়নি।
পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদ বলেন, আমাদের প্রচেষ্টা সকল সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জেরা দ্রুত সম্পন্ন করার। তবে, আসামি পক্ষের আইনজীবীগণের অসহযোগিতায় সেটা সম্ভব হয়না। তারা সাক্ষীকে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করেন। আর ১৫ আসামীর ১৫ আইনজীবী আলাদাভাবে আধাঘন্টা করে জেরার সময় নিয়ে সাড়ে সাতঘন্টা সময় লাগে। জবানবন্দি নিতেও সময় লাগে ঘন্টা দেড়েক। এতে আদালতের কর্মঘন্টা ৯ ঘন্টা এবং মধ্যহ্ন বিরতিসহ দাঁড়ায় ১০ ঘন্টা। ফলে, একজনের বেশি সাক্ষ্যে আগানো সম্ভব হয়ে উঠেনি। কিন্তু বিচার কার্যের ৭ম দিনে স্বল্প সময়ে জবানবন্দি ও জেরা শেষ হওয়ায় তৃতীয় দফার ধার্য্য দিনেও আসামী পক্ষের আইনজীবীগণ আদালতকে এভাবে সহযোগিতা করবেন বলে আমার বিশ্বাস।
আদালতের সংশ্লিষ্ট আইনজীবী বাপ্পী শর্মা জানায়, গত ২৩ আগস্ট শুরু হয় মেজর সিনহা হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম। সাক্ষ্যগ্রহণে আদালতের নির্ধারণ করা প্রথম তিনদিনের প্রথম দিন পুরো ও দ্বিতীয় দিনের অর্ধেক সময় মামলার বাদী নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন ফেরদৌসের সাক্ষ্য ও জেরা হয়। পরে শুরু হয় সিনহার সফরসঙ্গী ও হত্যার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী সিফাতের সাক্ষ্য। এ দু'জনের সাক্ষ্য ও জেরার মধ্য দিয়ে শেষ হয় বিচার কার্যের প্রথম নির্ধারিত তিন দিন। ফলে এ তিনদিনের জন্য নোটিশ পাওয়া ১৫ সাক্ষীর মাঝে বাকি ১৩ জনের সাক্ষ্য নেয়া সম্ভব হয়নি। ২৫ আগস্ট আদালত ৫ থেকে ৮ সেপ্টম্বর টানা চারদিন পরবর্তী সাক্ষ্যের জন্য দিন ধার্য্য করেন। সেই মতে ৫ সেপ্টেম্বর সকাল সোয়া ১০টার দিকে বাকি সাক্ষীদের একজনের সাক্ষ্য শুরু হয়ে সারাদিন তাকেই জেরায় দিন শেষ হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনও একই ভাবে একজন সাক্ষীর জবানবন্দি ও জেরা হয়েছে। শেষদিনও একই ভাবে একজনের সাক্ষ্য নেয়া হয়। এতে সাত দিনে সাক্ষ্য নেয়া গেছে মাত্র ৬ জনের। মামলায় মোট সাক্ষী ৮৩ জন। সাক্ষ্য ও জেরার সময় ১৫ আসামি কাঠগড়ায় উপস্থিত রাখায় পুরো জেলা জজ আদালত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। তার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এরপর সিনহা যেখানে ছিলেন, সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তার ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকে আটক করে। পরে তাহসিনকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এই দুজন পরে জামিনে মুক্তি পান।
সিনহা হত্যার ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়। ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, একটি রামু থানায়। ঘটনার পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। চারটি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় রর্যাব।
২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র্যাব-১৫ কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খায়রুল ইসলাম।
অভিযুক্ত আসামিদের মাঝে পুলিশের ৯ সদস্যরা হলেন, বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী, কনস্টেল রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া ও কনস্টেবল সাগর দেব নাথ।
অপর আসামিরা হলেন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্য এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজিব ও মো. আব্দুল্লাহ এবং টেকনাফের বাহারছড়ার মারিষবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও পুলিশের করা মামলার সাক্ষী নুুরল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন। আসামিদের ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে ওসি প্রদীপ, কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও সাগর দেব আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। এর আগে আসামিদের তিন দফায় ১২ থেকে ১৫ দিন রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল।