সিলেটের প্রতীক কিন ব্রিজ হতে যাচ্ছে দেশের দীর্ঘতম পদচারী সেতু
১৯৩৩ সালে ভারতবর্ষজুড়ে ইংরেজ শাসনের সময় বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ছোট্ট শহর সিলেটের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা নদীর ওপর একটি সেতু বানালেন ইংরেজরা। আসাম প্রদেশের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল কিনের নামে সেতুটির নামকরণ হল, ‘কিন ব্রিজ’।
এর পর সুরমার বুক দিয়ে কত জল গড়িয়েছে। লোকালয়ের পরিসর বাড়তে বাড়তে সিলেট আজ আস্ত এক বিভাগীয় শহর। শহরের পরিবর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে সেই চিরপুরাতন কিন ব্রিজের আশেপাশে গড়ে উঠেছে বহু স্থাপনা। ধনুকের মতো বাঁকানো লাল রঙের লোহার সেতুটিও তাই হয়ে গেছে সিলেট শহরের ঐতিহ্য, পর্যটন ও পরিচিতির অংশ।
নির্মাণের ৮৬ বছরের মাথায় এই সেতু নিয়ে বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন। সেতুতে সংস্কারের কথা বলে আপাতত যানচলাচল বন্ধ করেছেন তারা। তবে ঐতিহ্য ধরে রাখতে কেবল পদচারী সেতু হিসেবে কিন ব্রিজের ব্যবহারের বিষয়টি তাদের ভাবনায় রয়েছে।
কেবল পায়ে হেঁটে চলাচলের জন্য সেতুটি উন্মুক্ত রাখা হলে ১ হাজার ১৫০ ফুট দীর্ঘ কিন ব্রিজ হবে দেশের দীর্ঘতম পদচারী সেতু।
এ মাসের শুরুতে (১ সেপ্টেম্বর) মধ্যরাতে সেতুর দু’পাশে লোহার ব্যারিকেড দিয়ে যানচলাচল বন্ধ করে দেয় সিলেট সিটি করপোরেশন। এরপর শুরু হয় জরাজীর্ণ সেতুটির সংস্কার।
যানচলাচল বন্ধের পর, ৩ সেপ্টেম্বর সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে সেতুটি ঘুরে দেখেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। সে সময় তিনি সেতুটির সৌন্দর্য ও নির্মাণশৈল্পীতে মুগ্ধতা প্রকাশ করে এটি রক্ষায় যানচলাচল একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে মত দেন।
কিন ব্রিজের প্রধান আকর্ষণ তার স্থাপত্যশৈলীর নান্দনিকতা। এটি লোহা দিয়ে তৈরি। ধনুকাকৃতির বলে সেতুটিতে প্রথমে উপরের দিকে উঠে যেতে হয়। পরের অংশটুকু সমতল। শেষে আবার নিচের দিকে নেমে দেখা যাবে, সেতুটি মিলেছে মূল সড়কের সঙ্গে।
আশপাশের স্থাপনাও অনন্য করেছে কিন ব্রিজকে। সেতুর উত্তর দিকে সিলেটের পরিচিতির আরেক অনুষঙ্গ, ‘আলী আমজাদের ঘড়ি’। ঘড়িঘরের পাশে ঐতিহ্যবাহী চাঁদনিঘাট। এর পরই ঐতিহাসিক সারদা হল ও নান্দনিক স্থাপনার সার্কিট হাউস।
সব মিলিয়ে কিন ব্রিজসংলগ্ন এলাকাটি পর্যটক ও ইতিহাসবিদদের কাছে হয়ে উঠেছে তুমুল আকর্ষণের জায়গা।
সুরমা নদীর উপর নানা সময় আরও ৪টি সেতু তৈরি হয়েছে। কিন্তু নির্মাণের পর থেকে নগরীর প্রবেশদ্বারে পরিণত হয়েছে ছিয়াশি বছরের পুরনো কিন ব্রিজ।
একাত্তর সালে পাকিস্তানি বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে সেতুটির উত্তর পাশের একাংশ উড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর কাঠ ও বেইলি পার্টস দিয়ে বিধ্বস্ত অংশটি মেরামত করা হয়। ১৯৭৭ সালে সে অংশের পুনঃনির্মাণ হয় কংক্রিট দিয়ে। তবে এবারই প্রথম কিন ব্রিজের বড় ধরনের সংস্কার শুরু হল।
সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, “কিন ব্রিজ প্রতিষ্ঠার সময় ও এটির বর্তমান কাঠামোগত অবস্থা বিবেচনা করলে এটিকে একটি ফুটওভার ব্রিজে রূপান্তর করা যায়। এ জন্য আমরা সড়ক ও জনপথ বিভাগকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ওরা রাজি হয়েছে। সংস্কার চলাকালে এটির অবস্থা সরাসরি প্রত্যক্ষ করে দিয়ে এটি যানচলাচল পুরোপুরি বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, “কিন ব্রিজ সিলেটের প্রতীক। এর ছবি দেখে যে-কেউ বুঝে নেন যে জায়গাটা সিলেট। তাই সেতুটি রক্ষা করা জরুরি। কিন ব্রিজ রক্ষার স্বার্থে সেতুটি দিয়ে শুধু হেঁটে চলাচলের দাবি ছিল। আমিও চাই হেঁটে চলাচলের মধ্যে সচল থাকুক সেটি। এমনটি হলে এটি হবে দেশের দীর্ঘতম ফুটওভার ব্রিজ।”