সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে এখন আর চেনা যায় না!
গাঁজার আড্ডা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অরক্ষিত স্থাপনা, ভবঘুরেদের রাত্রিযাপন, যখন তখন গাছ কেটে পুড়িয়ে বায়ু দূষণ-এগুলোই এখন চারশো বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল বৈশিষ্ট্য।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হলেও এ উদ্যানে কার্যত প্রশাসনের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ নেই। সন্ধ্যার পর উদ্যানে প্রবেশ নিষেধ থাকলেও এখানে রাত্রিযাপন করে শতশত ভবঘুরে, যার ফলে সহজেই তারা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে।
মুঘল শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত এ উদ্যান বৃটিশ শাসন পার করে এখনো টিকে থাকলেও এসব ইতিহাসকে ধারণ করার কোন চিহ্ন নেই উদ্যানে। ঘোড়দৌড়ের জন্য বিখ্যাত এ উদ্যানের নাম একসময় দীর্ঘদিন রেসকোর্স ময়দান হলেও উদ্যানে ঢুকে কারো বোঝার উপায় নেই তা। তবে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে তুলে ধরতে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে আর কিছু প্রকল্প চলমান রয়েছে।
দেশের সর্ববৃহৎ উন্মুক্ত মঞ্চে বসে গাঁজার আসর
২৫-৩০টি গ্রুপে সব মিলিয়ে প্রায় ১৫০ জন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত মঞ্চের গোল গ্যালারিতে। কোন গ্রুপ গাঁজা তৈরি করছে। কোন গ্রুপ উড়াচ্ছে গাঁজার ধোয়া। আবার কোন গ্রুপ গাঁজা সেবনের পর গান গাইছে, সাথে আছে বাদ্যযন্ত্রও। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্মুক্তমঞ্চ এভাবেই রয়েছে গাঁজাসেবীদের দখলে। এ দৃশ্য গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার।
মঞ্চের আশপাশে ও পুরো উদ্যানজুড়ে ঘুরেফিরে নিয়মিত টহল দিচ্ছে শাহবাগ থানা পুলিশ। মঞ্চের গেটের সামনে আছে আনসার সদস্যও।
মঞ্চের ভেতর খালি গায়ে লুঙ্গি পরে ইতস্তত ঘুরে বেরাচ্ছে মতি মিয়া (ছদ্মনাম)। তিনি গাজা বিক্রি করছেন গ্রুপগুলোর কাছে। প্রতি পোটলা গাঁজার মূল্য ১০০ টাকা। ৪০ বছর বয়সী মতি মিয়ার বয়ানে জানা যায় ৮-১০ বছর বয়স থেকেই পার্কে থাকেন তিনি।
"এখানে থাকি গাঁজা বিক্রি করার জন্য। মাঝেমধ্যে রিক্সাও চালাই। ছোটবেলা থেকে এই পার্কেই ঘুমাই। অভ্যস্ততার কারণে এখানেই থাকতে ভালো লাগে। গাঁজা বিক্রির আয়ে ভালোই চলে যায় আমার," বলেন মতি মিয়া।
"প্রায় ১০ জন উদ্যানে নিয়মিত গাঁজা বিক্রি করে, তারা সবাই কারওয়ান বাজার রেললাইনের সামনে থেকে গাঁজা কিনে এনে এখানে বিক্রি করেন। এদের মধ্যে দুই নারী আছে যারা উদ্যানকেন্দ্রিক গাঁজার মূল বাজার দখল করে আছে। তাদের মধ্যে একজন মাথায় করে বোতলের পানি বিক্রির আড়ালে এগুলো বিক্রি করে, যা এককথায় 'ওপেন সিক্রেট'। আরেকজন খোলাখুলিই গাঁজা বিক্রি করে, কারো ধার ধারে না। আর বাকি যারা আছে তারা আমার মতো বিক্রেতা, লুকিয়ে বিক্রি করে, " বলেন মতি মিয়া।
সর্ববৃহৎ উন্মুক্ত মঞ্চের এরূপ ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর সচিব (উপ সচিব) মো. নওশাদ হোসেন বলেন, "অর্গানোগ্রামে লোকবল না থাকার কারণে মঞ্চের সার্বক্ষণিক দেখভাল করা সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে আমরা গার্ড দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। কাজ শুরু হয়েছে।"
উদ্যানের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে সেবন হয় গাঁজা, দর্শনার্থীরা সীমিত থাকেন বাকি ৪০ শতাংশে
শুধু উন্মুক্ত মঞ্চ নয়, পুরো পার্কের অবস্থাই প্রায় এমন। শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা জাদুঘর ও স্বাধীনতা স্তম্ভের চারপাশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত নয় বা ছোট ছোট গাছ রয়েছে এমন খোলা জায়গার পরিমাণ উদ্যানের প্রায় ৪০ শতাংশের মতো। এই জায়গাটুকুতে শুধু নগরের মানুষ পরিবার নিয়ে ঘুরতে পারে। বাকি জায়গায় বসে গাঁজার আসর।
এদিকে চারুকলা অনুচ্ছেদের উল্টোদিকের গেট দিয়ে প্রবেশ করে সড়ক ঘেষে রমনা কালিমন্দির পর্যন্ত ওয়াকওয়ের উপর আর পূর্ব দিকে গাছপালা আচ্ছাদিত মাঠে, একই গেট দিয়ে ঢুকে সোজা পূর্ব দিকে শিখা চিরন্তনের আগেই টিলার উপরে ও দুই পাশে, স্বাধীনতা জাদুঘর থেকে পশ্চিম পাশের সড়ক পর্যন্ত, এবং মন্দিরের উত্তর ও পূর্বপাশে ইঞ্চিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট পর্যন্ত মাঠে বসে শতাধিক ছোট ছোট গ্রুপ। দুই একটা গ্রুপ শুধু আড্ডার জন্য বসলেও বাকি গ্রুপগুলোর সবাই বসে গাঁজা সেবনের জন্য। মাঝে মধ্যে কিছু কিছু গ্রুপকে দেখা যায় তাস নিয়ে জুয়া খেলতে।
কখনো কখনো ভ্রাম্যমান আদালত জেল জরিমানা করে থাকে। কোন কোন সময় র্যাবের সহায়তায় গেট বন্ধ করে পরিচালনা করা হয় এসব অভিযান। আবার শাহবাগ থানা পুলিশ প্রায়ই আটক করে নিয়ে যায় গাঁজা সেবনরত কাউকে। এতোকিছুর পরও বন্ধ হয়নি নেশা, পরের দিনই দেখা যায় একই চিত্র।
হারুন অর রশিদ, সহকারি পুলিশ কমিশনার, রমনা জোন বলেন, "আমরা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। উদ্যানে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। এ অবস্থার পরিবর্তন আসবেই।"
দুই-তিন বছর আগেও ধর্ষণ, ছিনতাই আর পতিতাবৃত্তির কথা কেউ কেউ জানালেও এখন আর এসব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন উদ্যানের নিয়মিত বাসিন্দারা। তবে প্রেমিক যুগলদের কাছে হিজড়া সম্প্রদায়ের ভিক্ষাবৃত্তি চাঁদাবাজির পর্যায়ে পৌছেছে বলে তাদের অভিযোগ।
গাঁজাসেবীর বড় অংশ শিক্ষিত
গাঁজাসেবীদের একটা বড় অংশ শিক্ষিত সমাজের, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরিরত ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিল্পী, সাহিত্যিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। বাকিরা বখাটে নেশাখোর।
"যতোই অভিযান হোক, ঢাকা শহরে তুলনামুলক নিরাপদ এ জায়গা। এখানে শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সরকারি চাকুরীজীবি, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার অফিসার, রাজনীতিবিদ সবাই আসে বলে প্রশাসন তুলনামূলক সহনশীল। এজন্যই অফিস শেষে সন্ধ্যার সময় উদ্যানে আসি। অনেকক্ষণ গান গাই, আড্ডা দেই। তারপর বাসায় যাই। এভাবে সারাদিনের কাজের চাপ কমাই," বলেন বেসরকরি প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত শাকিল আকতার (ছদ্মনাম)।
নিয়মিতই উদ্যানে আসেন লেখক শহিদ সাদেকী (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, "ফ্রি স্পেস বলে একটা ধারণা আছে পশ্চিমা বিশ্বে। যেখানে নাগরিকেরা কারো ক্ষতি না করে নিজেদের মতো সময় কাটাতে পারে। কোন কোন দেশ পুরোটাই ফ্রি স্পেস, সবাই স্বাধীন। আমাদের মতো দেশে নাগরিকদের সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত। ব্যক্তিগত জীবনও আর ব্যক্তিগত থাকছে না, ঘরের ভেতরও ফ্রি স্পেস নাই। এ পরিস্থিতিতে এখানে কারো ক্ষতি না করে গাঁজা খাওয়া অথবা গান করা, এসবই নাগরিক অধিকার।"
"আইনে নিষিদ্ধ হলেও গাজার চেয়ে সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য বেশি ক্ষতিকর, " যুক্তি দেন তিনি।
রাতে দুই শতাধিক মানুষ উদ্যানে ঘুমায় যাদের প্রত্যেকের বাসা রয়েছে আশেপাশের এলাকায়। কৃত্রিম যে লেক তৈরি করা হয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভকে ঘিরে, তার পাড়ে দর্শনার্থীদের জন্য তৈরি করা বেঞ্চিগুলোতে রাতের বেলায় ঘুমের জায়গা পেতেই নাকি সমস্যা হয়। এদের মধ্যে ২৫-৩০ জনের মতো নারীও থাকে। সাথে থাকে তাদের শিশুরা।
একই ব্যবস্থাপনা তবুও বিস্তর পার্থক্য রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব-উত্তর দিকে রমনা পার্কের অবস্থান। এ পার্কটিও পরিচালনা করে গণপূর্ত অধিদফতর। তবে রমনা অনেকটাই সুসজ্জিত একটি পার্ক। সকাল-বিকাল এখানে লোকজন হাঁটাহাটি করে, শরীরচর্চা করে। বিভিন্ন জায়গায় ফুলের বাগান রয়েছে সুরক্ষিত। কেউ ফুল ছিঁড়ছেন না। সকলেই মাস্ক পরে হাঁটছে। কেউ সিগারেট খেলেও দায়িত্বরত আনসার এসে সেটি নিভিয়ে ফেলতে বলছেন। ফলে সুস্থ একটা পরিবেশে সাধারণ মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াতে পারেন পুরো পার্কজুড়ে।
অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কারো প্রবেশে কোন বাঁধা নেই। নেশা চলছে সর্বদাই। থামানোর সর্বাত্মক চেষ্টা নেই। চেষ্টা করলেও মানুষ তা মানছে না। বসবাস করছে ভবঘুরে মানুষজন।
গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা রয়েছে। সীমানা প্রাচীর সুরক্ষিত নয়। এছাড়া উদ্যানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করা আনসার বা পুলিশ সকলের জন্যই কঠিন। এসব কারণে সঠিক ব্যবস্থাপনা সম্ভব হচ্ছে না।
গণপূর্ত অধিদফতরের ঢাকা মেট্রোপলিটন জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার বোস বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন। তারা যেভাবে নির্দেশনা দেয় সেভাবেই তা বাস্তবায়ন করে গণপূর্ত অধিদফতর।
এ বিষয়ে জানতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ ও অতিরিক্ত সচিব প্রশাসন এম ইদ্রিস সিদ্দিকীকে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোন সাড়া দেন নি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মোট জমির পরিমান ৯৫ একর। জমির মালিক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ উদ্যানের মধ্যে রয়েছে রমনা কালী মন্দির, জাতীয় শিশুপার্ক, শাহাবাগ থানা। উদ্যানের মালিক গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। সার্বিকভাবে এ উদ্যানের দেখভালের দায়িত্ব গণপূর্ত অধিদফতরের। উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে রয়েছে শিখা চিরন্তন, উন্মুক্ত মঞ্চ, স্বাধীনতা স্তম্ভ, স্বাধীনতা জাদুঘর, কৃত্রিম লেক, শিশু পার্ক, শাহবাগ থানা ও রমনা কালী মন্দির। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা এগুলোর দেখভাল ও ব্যবস্থাপনা করে থাকে।
এছাড়া টিএসসির উল্টোদিকে উদ্যানের ঠিক বাইরে জমে উঠেছে দোকানপাট, এ জায়গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। চারুকলার উল্টোদিকে কিছু জায়গা সাময়িক বরাদ্দ পেয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।
অপরিকল্পিত বৃক্ষ নিধন
ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শতাধিক পুরোনো গাছ কাটা হয় সম্প্রতি। পরে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনা আসে আপাতত গাছ না কাটার জন্য। এসব গাছ কেটে বা ঝড়ে পড়ে যাওয়া গাছ কুড়িয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয় নিয়মিত, ফলে বাতাসে মিশে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বস্তুকণা।
যদিও হাইকোর্টের নির্দেশ রয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কোন স্থাপনা করলে হাইকোর্টের অনুমোদন নিয়ে করা। তারপরও এভাবে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের প্রতিবাদ জানায় বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে। তবে মুঘল আমল ও বৃটিশ আমলের কোন স্মৃতিচিহ্ন বা কাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেই।