হলি আর্টিজান মামলা: পেপারবুক যাচাই-বাছাইয়ে আটকা ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি
বহুল আলোচিত রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া সাতজনের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডের অনুমোদন) ও দণ্ডিতদের আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
এই শুনানির জন্য গত বছর আগস্ট মাসে পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) প্রস্তুত হলেও তা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র (জেলা ও দায়রা জজ) মোঃ সাইফুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ডেথ রেফারেন্স ও আপিল সংক্রান্ত পেপারবুক (মামলার এফআইআর থেকে শুরু করে রায় পর্যন্ত সকল কাগজপত্রের ফাইল) বিজি প্রেস থেকে প্রস্তুত হয়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পৌছেছে। এখন পর্যন্ত সেটি যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করছে হাইকোর্ট প্রশাসন।
তিনি বলেন, যাচাই-বাছাই শেষ হলেই বিধি অনুযায়ী পেপারবুক প্রধান বিচারপতির কাছে উপস্থাপনের পর, তিনি এই বিষয়ে শুনানির জন্য একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ নির্ধারণ করলেই শুনানি শুরু হবে।
তবে করোনার কারণে পেপারবুক যাচাই-বাছায়ের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে একটু বিঘ্ন ঘটেছে। এছাড়াও প্রত্যোক আসামীর জন্য পৃথক একটি করে পেপারবুক রয়েছে। একেকটি পেপরবুক কয়েক হাজার পৃষ্ঠার। ফলে সময় বেশি লাগছে।
আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হলেই এই শুনানির জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হবে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র।
আইনজীবীরা জানান, ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালত যখন আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দেন তখন ওই দণ্ড কার্যকরের জন্য হাইকোর্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা মোতাবেক মামলার সব নথি হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেন। যা ডেথ রেফারেন্স নামে পরিচিত। ওই নথি আসার পর হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করে। পেপারবুক প্রস্তুত হলে মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
প্রস্তুত হওয়ার পর প্রধান বিচারপতি একটি বেঞ্চ নির্ধারণ করলে ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, শীঘ্রই আলোচিত এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে। হাইকোর্টের সশ্লিষ্ট শাখা পেপারবুক যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করছে। আশা করা যায়, দ্রুত তাদের কাজ সম্পন্ন হবে এবং এ বিষয়ে শুনানির উদ্যোগ নিতে পারবে অ্যাটর্নি জেনারেল আফিস।
আলোচিত এই মামলার বিচারকাজ শেষে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ৭ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন আদালত।
সে রায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলো: জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেওয়া হয়েছে রায়ে।
দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন এ হত্যাযজ্ঞের ঘটনার রায় দিতে গিয়ে আদালত বলেন, 'বাংলাদেশে তথাকথিত জিহাদ কায়েমের লক্ষ্যে এবং জননিরাপত্তা বিপন্ন করার ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস'র দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জেএমবির একাংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবির সদস্যরা হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকাণ্ড ঘটায়।'
এ হত্যাকাণ্ডের ফলে শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য পরিচিত বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে মন্তব্য করে রায়ে আদালত বলে, 'তাই সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে আসামিরা কোনো ধরনের অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না। এক্ষেত্রে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা প্রদানই ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবে, আর এতে ভাগ্যাহত মানুষের স্বজনরা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।'
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত ৯টার দিকে রাজধানীর গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের পাশে অবস্থিত হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা হামলা চালায়। তারা অস্ত্রের মুখে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে।
সেই রাতে সেখানে অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা রবিউল করিম ও সালাউদ্দিন খান নিহত হন। এছাড়াও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৩১ সদস্য ও র্যাব-১ এর তৎকালীন পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদসহ ৪১ জন আহত হন। পরদিন ২ জুলাই ভোরে সেনা কমান্ডোদের পরিচালিত 'থান্ডারবোল্ট' নামের অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়।
এরপর পুলিশ সেখান থেকে ১৮ বিদেশিসহ ২০ জনের লাশ উদ্ধার করে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরও একজন রেস্তোরাঁকর্মী। কমান্ডো অভিযানের আগে ও পরে ৩২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
দেশের মানুষকে হতবাক করে দেয়া সেই হামলার তিন দিন পর গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার দাস সন্ত্রাস দমন আইনে গুলশান থানায় মামলা করেন। এরপর ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির দুই বছর তদন্ত করে ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এরপর আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ, আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিদের বক্তব্য উপস্থাপন এবং উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বরে রায় ঘোষণা করেন আদালত।
আসামী পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'পেপারবুক চূড়ান্ত না হওয়ায় হাইকোর্টে এ বিষয়ে শুনানির পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আসামীরাও আপিল করেছে। পেপারবুকের কাজ সম্পন্ন হলে আসামী পক্ষে আপিল শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। আশা করি আপিলে আসামীরা খালাস পাবে।'