হলুদ চাষে আগ্রহ কমছে রাজশাহীর কৃষকদের
রাজশাহীতে বছরে ৮০ কোটি টাকার হলুদ ব্যবসা হয়। হলুদ চাষের সঙ্গে জড়িত আছে রাজশাহীর ১৫ থেকে ১৬ হাজার কৃষক। রাজশাহীর হলুদ ঢাকাসহ সারাদেশে যায়। তবে ভারত থেকে হলুদ আমদানি করায় কৃষকরা এখন লোকসানের মুখে পড়েছেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, রাজশাহীর সব উপজেলায় হলুদ চাষ হলেও জেলার মধ্যে পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি হলুদ চাষ হয়। গতবছর রাজশাহী জেলায় এক হাজার ৮৩৯ হেক্টর জমিতে হলুদের চাষাবাদ হয়েছিল। সেখান থেকে শুকনো হলুদ পাওয়া গেছে ৬ হাজার ৫৫১ মেট্রিক টন। এ বছর দুই হাজার ৩৪ হেক্টর জমিতে হলুদের চাষ হয়েছে। আর দেড় মাস পরই কৃষকরা হলুদ তুলতে শুরু করবেন।
গত ১০ বছরের চাষাবাদের পরসিংখ্যান থেকে দেখা গেছে, গড়ে প্রতি বছর ৬ থেকে ৭ হাজার মেট্রিক টন শুকনা হলুদ উৎপাদন হয়েছে রাজশাহীতে। প্রতি কেজি শুকনা হলুদের দাম গড়ে ১২০ টাকা ধরা হলে এক মেট্রিক টন হলুদের দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ৬ হাজার ৫৫১ মেট্রিক টন হলুদের দাম দাঁড়ায় ৭৮ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকা।
কৃষকরা জানান, হলুদের বীজ জমিতে বপনের পর পাঁচ থেকে ছয় মাস লাগে হলুদ পরিপক্ক হতে। তখন বিঘা প্রতি কাঁচা হলুদ হয় ৭০ থেকে ৮০ মণ। এরপর সেই কাঁচা হলুদ গরম পানিতে সিদ্ধ করে জমিতে শুকাতে হয়। ২০ থেকে ২৫ দিন শুকানোর পর শুকনো হলুদ পাওয়া যায়। শুকনা হলুদ কেজি প্রতি ১২০ থেকে ১৫০টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও কাঁচা হলুদ বিক্রি হয় ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে। চার থেকে পাঁচ মণ কাঁচা হলুদ শুকানোর পর এক মণ শুকনা হলুদ পাওয়া যায়।
কৃষকরা জানান, আগে মাঠর্ভতি হলুদ চাষ করতেন কৃষকরা। তখন উৎপাদনও ভালো হতো, দামও বেশি পাওয়া যেত। তবে এখন বেশির ভাগ চাষীরা হলুদ চাষ করেন আম বাগানে সাথী ফসল হিসেবে। আম বাগানে চাষ করায় হলুদের উৎপাদনও কমে গেছে। আগে যেখানে বিঘা প্রতি ১০০ মণ র্পযন্ত কাঁচা হলুদ পাওয়া যেত এখন সেখানে ৭০ থেকে ৮০ মণ হলুদ পাওয়া যায়। বেশিরভাগ কৃষকরা সাথী ফসল হিসেবে উঁচু ভিটায়, পতিত জমিতে এবং বাড়ির আঙিনায় হলুদ চাষ করে থাকেন।
চারঘাট উপজেলার কালুহাটি গ্রামের কৃষক শাহাবুল হক জাহাঙ্গীর জানান, ১০ বছর আগে পাঁচ বিঘা জমিতে হলুদ চাষ করতাম। এখন সেখানে দুই বিঘা জমিতে হলুদ চাষ করছি। তাও আম বাগানের সাথী ফসল হিসেবে। বেশির ভাগ কৃষকরা এখন সাথী ফসল হিসেবে হলুদ চাষ করেন। সাথী ফসল হিসেবে চাষাবাদ করায় হলুদের উৎপাদনও কমে গেছে।
একই গ্রামের কৃষক মিল্টন মন্ডল জানান, এবছর হলুদে পচা রোগ বেশি দেখা দিয়েছে। গাছের পাতা মরে যাচ্ছে। গাছের পাতা মরে গেলে হলুদের উৎপাদন কমে যায়। কীটনাশক ওষুধ দিয়ে রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। এক বিঘা জমিতে হলুদ চাষ করতে ১০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। প্রথম কয়েক দফা জমি চাষাবাদ করে সার দিয়ে জমি প্রস্তুত করার পর বীজ বপন করতে হয়। হলুদ গাছ বড় হয়ে গেলে তখন শুধু কীটনাশক দিলেই চলে।
বাঘার আড়ানী এলাকার কৃষক মোখলেসুর রহমান জানান, আগে আড়ানী এলাকার কৃষকরা হলুদ উৎপাদন ও বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। তখন এমন কোনো পরিবার ছিল না যারা হলুদ চাষ করে না। এখন বেশিরভাগ কৃষকই হলুদ চাষ কমিয়ে দিয়েছেন। হলুদের জায়গায় এখন আম বাগান করছেন। মাঠ র্ভতি সবজি চাষাবাদ করছেন কেউ কেউ। সবজি বিক্রি উপযোগী হতে খুব বেশি সময় লাগে না। পরিশ্রমও কম।
মোখলেসুর রহমান আরও বলেন, এ বছর আমি ৪ কাঠা জমিতে বেগুন চাষ করে আয় করেছি ৬১ হাজার টাকা। যা হলুদ চাষের চেয়ে লাভজনক। তারপরও আমার ১৫ কাঠা জমিতে হলুদ রয়েছে।
রাজশাহীর মধ্যে আড়ানী বাজারে সপ্তাহে দুইদিন হলুদের হাট বসে সেখানে প্রতি হাটে ৫০০ থেকে এক হাজার মণ হলুদ বেচাকেনা হয়। ১০ থেকে ১৫ জন আড়তদার রয়েছে সেখানে।
মোল্লা ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক নূর মোহাম্মদ মোল্লা জানান, তারা প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ হাজার মণ শুকনা হলুদ বিভিন্ন কৃষকদের কাছ থেকে কিনেন। তারপর সেই হলুদ তাদের কারখানাতে বাছাই করেন। বাছাইয়ের জন্য ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক কারখানায় কাজ করেন। বাছাই শেষে আকৃতিভেদে প্যাকেটজাত করে তারা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। আবার সরাসরি হলুদ গুঁড়া তৈরির কোম্পানির কাছেও হলুদ বিক্রি করেন।
৪৫ বছর ধরে হলুদ ব্যবসার সাথে জড়িত আড়ানী বাজারের একরামুল হক সনৎ। তিনি জানান, ভারত ও মিয়ানমার থেকে হলুদ আমদানীর কারণে আমাদের দেশের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা মার খাচ্ছেন। সরকার প্রায় ৬০ ভাগ হলুদ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানী করছে। ফলে কৃষকরা হলুদ উৎপাদন করে উৎপাদন খরচ তুলতে পারছে না। অথচ অন্য দেশের তুলনায় আমাদের হলুদের মান ভালো। আগের মতো হলুদ ব্যবসা আর লাভজনক না। বহুবছর ধরে হলুদ ব্যবসা করায় আর এই পেশা পরিবর্তন করতে পারিনি।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধদিপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শামসুল হক অবশ্য দাবী করেন, আগের চেয়ে আবাদের পরিমাণ কমলেও হেক্টর প্রতি হলুদ উৎপাদন বেড়েছে। কৃষকরাও হলুদ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। আগে যেখানে কৃষকরা হলুদ লাগিয়ে ফেলে রাখতেন, এখন সেখানে সার, সেচ ও কীটনাশক দেওয়ায় হলুদ উৎপাদন বেড়েছে। এছাড়া হাইব্রিড, বারি ও উফসী জাতের কিছু হলুদের উৎপাদন বেশি হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। আমরাও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে হলুদ চাষে কৃষকদের সহযোগিতা করছি। এখন চেষ্টা করা হচ্ছে স্থানীয় জাত বাদ দিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ উদ্ভাবিত বেশি ফলনের হলুদ যাতে চাষীরা চাষাবাদ করেন সেই বিষয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে।