১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার
ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে মানুষকে ফাঁদে ফেলে নির্বিঘ্নে প্রতারণা চালিয়ে যেতেন তিনি।
ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মসজিদের ইমাম, ধর্মীয় সংগঠনে নিয়োজিত ব্যক্তি—সবাই ছিল তার টার্গেট। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, রাগীব তার মাল্টি-লেভেল-মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা চালানোর নামে তাদের কাছ থেকে 'বিপুল পরিমাণ অর্থ' হাতিয়ে নিয়েছেন।
১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এহসান গ্রুপ পিরোজপুর—বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান রাগীব আহসান ও তার ছোট ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর তোপখানা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন শুক্রবার গণমাধ্যমকে জানান, ধর্মীয় অনুভূতি ও আবেগকে পুঁজি করে মানুষকে ফাঁদে ফেলতেন রাগীব আহসান।
এই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, 'তিনি ধর্মপ্রাণ মানুষ, মাদ্রাসা শিক্ষক ও ইমামদের টার্গেট করতেন।'
রাগীব ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষক ও ইমাম। ২০০৮ সালে তিনি এমএলএম ব্যবসা শুরু করেন এবং এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি এই গ্রুপের অধীনে ১৭টির মতো কোম্পানি চালু করেন।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাগীব ও তার ভাইকে গ্রেপ্তার করার সময় তাদের কাছ থেকে নগদ মাত্র ২ হাজার ৫০০ টাকা, চারটি ভাউচার প্যাড ও দুটি স্বল্পমূল্যের স্মার্টফোন জব্দ করেছে।
রাগীব ও তার সঙ্গীরা প্রতারণার এত বিপুল অর্থ কোথায় রেখেছেন, সে সম্পর্কে জানতে চাইলে র্যাব বলে যে এ বিষয়ে তাদের কাছে এখন কোনো তথ্য নেই। বিষয়টি অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খতিয়ে দেখবে।
ভুক্তভোগীদের কথা উল্লেখ করে র্যাব বলে, এমএলএম ব্যবসার নামে মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করা টাকা দিয়ে রাগীব তার কোম্পানি ও পরিবারের সদস্যদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি ও সম্পত্তি কিনেছেন।
গত ৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, রাগীব ও তার পরিবার সাধারণ মানুষের থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
র্যাব জানিয়েছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ১১০ কোটি টাকা অপব্যবহারের কথা স্বীকার করেছেন।
পিরোজপুর শহরের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবসায়ী মাওলানা আলী আকবর। প্রতি মাসে ১ লাখ টাকার বিপরীতে ১ হাজার ৮০০ টাকা মুনাফার প্রস্তাবে আকৃষ্ট হয়ে ২০১২ সালে তিনি এহসান গ্রুপে বিনিয়োগ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি পর্যায়ক্রমে তিনি বিনিয়োগ বাড়াতে থাকেন। ২০১৮ সাল নাগাদ তার বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় সোয়া ২ কোটি টাকায়।
আলী আকবরের ছেলে সাইফুল্লাহ বলেন, 'প্রথম দুই-তিন বছর মাসিক পেমেন্ট মোটামুটি ঠিকমতোই দেওয়া হতো। কিন্তু ২০১৫ থেকে এটা কমতে শুরু করে। ২০১২ সালে টাকা দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।'
র্যাব বলেছে, রাগীব 'শরিয়াভিত্তিক বিনিয়োগ' বলে প্রচারণা চালিয়ে তার 'টার্গেটদের' প্রলুব্ধ করতেন। প্রচারণার জন্য তিনি ধর্মীয় সমাবেশের পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন।
র্যাবের তথ্যানুসারে, ২০০৮ সালে রাগীবের গ্রাহক ছিল ১০ হাজার জন। গ্রাহকসংখ্যা এখন ১ লাখ ছাড়িয়েছে।
র্যাব বলেছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব জানিয়েছেন যে এহসান গ্রুপের প্রায় ৩০০ মাঠ পর্যায়ের কর্মী রয়েছে। তাদেরকে গ্রাহক সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কর্মচারীরা মাসিক বেতন পায় না, তারা তাদের সংগ্রহ করা বিনিয়োগের জন্য ২০ শতাংশ কমিশন পায়।
র্যাব বলে, 'গ্রাহকদের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কর্মচারীর সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন তিনি।'
র্যাব জানিয়েছে, কিছু ভুক্তভোগী পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগ করেছে।
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, ২০১৯ সালে একটি জালিয়াতির মামলায় রাগীবকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সারা দেশে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা ১৬টি মামলা সম্পর্কে তারা জানতে পেরেছেন। গ্রাহকদের টাকা ও মুনাফা ফেরত দিতে না পারার জন্য ২০১৯ সাল থেকে পলাতক রয়েছেন রাগীব।
পিরোজপুরের পুলিশ সুপার বলেন, তারা মাত্র দুটি মামলা সম্পর্কে জানেন। যদিও র্যাবের দাবি, রাগীবের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা হয়েছে। পিরোজপুরের এসপি বলেন, অভিযুক্তদের হেফাজতে আনার জন্য মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইতিমধ্যে পিরোজপুর থেকে ঢাকা রওনা হয়েছেন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, 'আমরা জানতে পেরেছি যে এহসান গ্রুপ সারা দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করলেও কিন্তু কোম্পানিটি মূলত পিরোজপুরভিত্তিক ছিল। রাগীব সেখানে ১৭টির মতো কোম্পানি স্থাপন করেছিল। এর মধ্যে ১৬টি এখন বন্ধ।'
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব জানিয়েছেন, এহসান রিয়েল এস্টেটের নামে তার কিছু স্থাপনা ও জমি আছে।
র্যাব আরও জানায়, সম্প্রতি যারা রাগীবের এমএলএম কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন, তারা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট ও পিরোজপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
মাওলানা হারুন-অর-রশিদ নামে একজন ভুক্তভোগী এবং তার মতো আরও ১ হাজার ২০০ জন অর্থ আদায়ের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছেন।
হারুন টিবিএসকে জানান, রাগীব ও তার পরিবার পিরোজপুর শহরের নূর মদিনা ভবনের একটি বিলাসবহুল বাড়িতে থাকেন।
হারুন বলেন, রাগীবের ভাই মাওলানা আবুল বাশার এবং তার স্ত্রী ও শ্বশুর ঢাকায় জমি ও ফ্ল্যাট কিনেছেন।
হারুন আরও বলেন, 'আমরা ঢাকার সাভার ও নারায়ণগঞ্জে তার জমি কেনার দলিল জোগাড় করেছি।'
১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় এর চেয়েও অনেক বেশি হবে।
'আমরা ১ হাজার ২০০ মাঠকর্মীর একটি তালিকা তৈরি করেছি। তাদের মাধ্যমে আমরা ২ হাজার ৩০০ কোটি থেকে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার আমানত সম্পর্কে নথি সংগ্রহ করেছি। এছাড়া অনেকেই আছেন যারা বড় বিনিয়োগ করেছেন।'