‘মানুষ আমার ছবি তোলে কেন’
“মানুষ আমাকে দেখলেই মোবাইল বের করে হেসে হেসে ভিডিও করে, ছবি তোলে। কিন্তু কেন? আমার মাঝে কী পেয়েছে তারা? মানুষ কি বোঝে না আমাদের অবস্থা? বাবা-বোনসহ পরিবারের পাঁচজনকে হারিয়েছি। সে জন্য আমার ছবি তুলতে হবে?”
কথাগুলো বলছিলেন মৌলভীবাজার শহরের অগ্নিকাণ্ডে বাবা, বোনসহ পরিবারের সদস্যদের হারানো প্রিয়াংকা রায়।
শোকে মুহ্যমান প্রিয়াংকার সঙ্গে দেখা হয় আগুনে পুড়ে যাওয়া পিংকি শু স্টোরের পাশের একটি দোকানে। সেখানে তিনি বসে ছিলেন।
গত ২২ জানুয়ারি বিয়ে হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী এ শিক্ষিকার। ২৭ জানুয়ারি ছিল তার বউ ভাত। আর ২৮ জানুয়ারি পরিবারের পাঁচজনকে হারান তিনি। এ শোক নিয়েই পরিবার সামলাচ্ছেন।
প্রিয়াংকার মা অসুস্থ। আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া বোনও ঠিকমত দাঁড়াতে পারছেন না। বাবাকে হারানোর পর পরিবারের একমাত্র অভিভাবক হার্টের রোগী চাচা মনা রায় আইসিইউ থেকে ফিরেছেন গত বুধবার রাতে।
এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে সবকিছু সামলাতে হচ্ছে প্রিয়াংকাকে। অন্যদিকে তদন্ত কমিটিসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন তাদের সঙ্গে কথা বলতে আসছেন।
যখনই বাইরে যাচ্ছেন, কিছু মানুষ মোবাইল ফোনে প্রিয়াংকার ছবি তুলছে, ভিডিও করছে। বিষয়টি দেখে অবাক প্রিয়াংকা। তিনি এই প্রতিবেদককে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘‘আমার সব হারিয়ে গেছে। মানুষ কি করে হেসে হেসে আমার ভিডিও, ছবি ধারণ করছে? মানুষের বিবেক কোথায়?’’
প্রিয়াংকা জানান, আগুন লাগার খবর শুনে যখন তিনি দৌড়ে আসেন, তখনো কিছু মানুষ তার ছবি তুলছিল। তখন তিনি বুঝতে পারেননি কেন মানুষ ছবি তুলছে।
গত মঙ্গলবার সকালে মৌলভীবাজারের সাইফুর রহমান সড়কের পিংকি শু স্টোরে অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন পাঁচজন। তাদের মধ্যে প্রিয়াংকার বাবা পিংকি শু স্টোরের মালিক সুভাষ রায় (৬৫), বোন প্রিয়া রায় (১৯), চাচী দিপ্তী রায় (৪৮), মামী দীপা রায় (৩৫) ও মামাতো বোন বৈশাখী রায় (৩)।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে সুভাষ রায়ের বাবা ও বড় ভাই দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। এক সময়ের জমিদার এই পরিবারের শেষ সম্বল ছিল দোকানটি, যা পুড়ে ওই পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। হারিয়ে গেছে মাথা রাখার জায়গাটুকুও।
নিহত সুভাষ রায়ের মেয়ে প্রিয়াংকা বলেন, ‘‘আমাদের পরিবারের কিছুই নেই। আমার বাবা, বোন, মামী, মামাতো বোন সব শেষ হয়ে গেছে। কীভাবে বেঁচে আছি, তা কী করে যে বোঝাই?’’
ঘটনার দিন অতি উৎসাহী মানুষের মোবাইলে ছবি ও ভিডিও ধারণে ব্যাহত হয় উদ্ধার কাজ। বারবার মানুষ সরাতে ভূমিকা নিতে হয় পুলিশকে।
মৌলভীবাজার মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পরিমল দাস বলেন, "মানুষের নৈতিকতার যে অবক্ষয় ঘটেছে, তা এই রকম ঘটনায় আমরা প্রমাণ পাই। প্রতিটি বড় ঘটনায় কিছু মানুষ ছবি তুলতে গিয়ে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।"