কেন টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের মর্যাদাও নিশ্চিত করা দরকার
কাছাকাছি সময়ে দুই বিপরীতমুখী বাংলাদেশের ছবি দেখা গেল। একদিকে দীর্ঘ দিনের আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে উন্নয়নের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। অপরদিকে শিক্ষার্থীসহ উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে লাঞ্ছিত হওয়া শিক্ষকের প্রতিনিধি।
ধর্ম অবমাননার ধোয়া তুলে শিক্ষকদের হেনস্তা করার ঘটনা এখন মোটামুটি নিয়মিতই ঘটছে দেশে। এ বছর শুরুটা হয় মুন্সিগঞ্জের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের মাধ্যমে। গত মার্চে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে একদল মানুষ। তার জেরে হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে অবশ্য তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
তারপর গত ১৭ জুন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার সমর্থনে ফেসবুকে পোস্ট দেয় নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক হিন্দু শিক্ষার্থী। পরদিন ১৮ জুন দিনভর নড়াইল কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, সহিংসতা চলে। সে সময় গুজব ছড়ানো হয় যে, ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। এরপর পুলিশ পাহারায় বিকেলে স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দাঁড় করিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয় একদল ব্যক্তি। এ কাণ্ডটি করা হয় পুলিশের উপস্থিতিতেই।
এরপরের ঘটনা ২৫ জুনের। এবারের ঘটনা আরও ভয়াবহ। ২৫ জুন সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। ২৭ জুন ভোরে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় উৎপলের মৃত্যু হয়।
সর্বশেষ ১ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক রতন সিদ্দিকীর ঢাকার উত্তরার বাসায় হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে 'নাস্তিকতা'র অভিযোগ তুলে এ হামলা চালানো হয় বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর।
দেশ যখন প্রতিনিয়ত উন্নতির পথে হাঁটছে, একের পর এক অবকাঠামো গড়ে উঠছে, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে, সেই মুহূর্তে শিক্ষকদের ওপর এ ধরনের আক্রমণ আমাদের অনেকগুলো প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, তা কি সত্যিকার অর্থেই টেকসই উন্নয়ন? সাদা চোখে যতটুকু উন্নয়ন দেখতে পাচ্ছি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সত্যিকার অর্থে তরুণ প্রজন্মকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারছে? শিক্ষকদের মতো সম্মানিত পেশার মানুষদের এভাবে বারবার লাঞ্ছিত করে দেশের উন্নয়ন সত্যিকার অর্থে কতটুকু টেকসই হবে?
একটু গভীরে তাকালে দেখতে পাব, বাংলাদেশে শিক্ষকরা যেমন সামাজিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন, তেমনি আর্থিকভাবেও তারা নিরাপত্তার তলানিতেই আছেন। বলা হয়, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড আর শিক্ষক সেই জাতি বা মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর। কিন্তু জাতি গড়ার কাজে যারা নিজের শ্রম, ঘাম দিচ্ছেন, তারা কতটুকু আর্থিক নিরাপত্তা পাচ্ছেন? বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, অন্যান্য অনেক উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শিক্ষকরা অনেক কম বেতন পেয়ে থাকেন। তার ওপরে প্রভাবশালীদের হাতে নানাভাবে লাঞ্ছনার শিকার তো হনই। এর ফলে মেধাবীরা এ পেশায় আসতে আগ্রহী হন না। যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণে ও পড়াশোনায়।
কাজেই একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়—অর্থনৈতিকসহ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকেই শক্তিশালী ও টেকসই করার জন্য শিক্ষা খাতে, অন্য কথায় শিক্ষকদের ওপর বিনিয়োগ করার বিকল্প নেই। শিক্ষকদের মর্যাদা—সামাজিক ও আর্থিক দুটোই—নিশ্চিত করা না গেলে উন্নয়নকে টেকসই করা যাবে না।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, যেসব দেশ উন্নত হয়েছে, তারা সবাই শিক্ষকদের পেছনে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। যেমন শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ চীন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াও তাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য শিক্ষা খাতের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে।
বার্তাটি পরিষ্কার—শিক্ষকদের মর্যাদা বাড়ানোর ওপর যত বেশি বিনিয়োগ করবেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা তত ভালো পারফর্ম করবে।
কিন্তু বাংলাদেশে চিত্র পুরোই বিপরীত। আর এর ফলও চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি—অদক্ষ ও আধাদক্ষ জনবল, নৈতিকভাবে অবক্ষয় হওয়া শিক্ষার্থী।
উদাহরণ হিসেবে চীনের কথাই ধরা যাক। ২০১৮ সালে অরগানাইজেশন অভ ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) আয়োজিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিক্ষা পরীক্ষায় পড়া, গণিত ও বিজ্ঞানে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল দেশটির শিক্ষার্থীরা। গ্লোবাল টিচারস' স্ট্যাটাস ইনডেক্সেও চীনের শিক্ষকরা শীর্ষ অবস্থানে থাকেন। এর ফলে দেশটি প্রায় সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে গেছে তরতর করে। চীন এখন টেক জায়ান্ট।
শিক্ষকদের মূল্যায়নে সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়াও শীর্ষ দশে ছিল ২০২০ সালে। দেশ দুটির উন্নতির গল্প নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।
সমাজে শিক্ষকদের অবস্থানের সঙ্গে স্কুলে শিশুদের পারফরম্যান্সের সম্পর্ক থাকার প্রমাণ হলো এই সূচক।
২০১৫ সালে ওইসিডির পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হলো শিক্ষা।
শিক্ষায় বিনিয়োগ করে সুফল তোলার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নত দেশগুলোর জোট ওইসিডিতে নাম লেখানো একমাত্র রাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়া।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষায় ১ ডলার বিনিয়োগ করলে তার ১৫ ডলার পর্যন্ত অর্থনৈতিক উপযোগিতা তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা সম্ভব হলেও দুর্বল অবকাঠামো এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
এত অল্প বিনিয়োগের ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী অদক্ষ ও আধাদক্ষ থেকে যাচ্ছে। দক্ষতা কম থাকায় বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মীরা কম পারিশ্রমিক পান। অন্যদিকে ফি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে আমরা বিদেশি কর্মী আনছি। তৈরি পোশাক খাতের কথাই ধরা যাক। শ্রমিক থেকে নির্বাহী পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে দক্ষ জনবলের অভাবে ভুগছে খাতটি। এর ফলে কারখানা মালিকরা বিভিন্ন পদে বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
২০১৩ সালের গ্লোবাল টিচার স্ট্যাটাস ইনডেক্সের তথ্যানুসারে, ২০টির বেশি দেশের শিক্ষকদের বেতন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষকদের বেতনের চেয়ে বেশি। এই দেশগুলোর মধ্যে আছে দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, কানাডা, পর্তুগাল, তুরস্ক, ডেনমার্ক, গ্রিস, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড।
কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষকতা সম্মানজনক পেশা হয়ে উঠতে পারেনি। তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের সমমর্যাদা পান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। মর্যাদা ও বেতন বাড়ানোর দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন তারা।
এসব সমস্যা বহুদিন আগেই চিহ্নিত করা হয়েছে। সবাই-ই দীর্ঘদিন ধরে সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।
এত সব বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করেও আমাদের শিক্ষকরা কাজ করে যাচ্ছেন। লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন, নিজ ছাত্রের পিটুনি খেয়ে খুনও হচ্ছেন। এমনিতেই তারা আর্থিকভাবে তেমন শক্তিশালী নন। সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও বেতন-ভাতাদিতে পিছিয়ে থাকেন। শেষ অবলম্বন ছিল সম্মান। সেই সম্মানও এখন খোয়াচ্ছেন। সবদিক থেকে বঞ্চিত করে তাদের কাছ থেকে গুণগত শিক্ষাদান আশা করা বাতুলতারই নামান্তর।
শিক্ষায় যথাযথ বিনিয়োগের অভাবে মেধাবীরা আসছেন না এ পেশায়। যারাও বা আছেন, তারাও গুণগত শিক্ষা দেওয়ার তাগিদ ঠিকমতো পাচ্ছেন না। এর ফলাফল ইতিমধ্যে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। তাই দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার আগে সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষকদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তা না হলে এ পর্যন্ত যত অর্জন, তার সবই বিফলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।