‘সাদা সোনা’: চিংড়ি চাষ যেভাবে সমাধান না হয়ে ব্যাপক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে
ঝুঁকে বসে সারি সারি খাঁচাবন্দি কাঁকড়া পরীক্ষা করছিলেন আসাদুল ইসলাম। এক মনে খুঁজে চলেছিলেন, সদ্য খোলস ছেড়েছে এমন কাঁকড়া। এই অবস্থায় কাঁকড়ার খোলস নরম থাকে অল্পকিছু সময়ের জন্য। তাই দ্রুত সেগুলোকে ধরার পর রপ্তানির জন্য হিমায়িত করতে হয়।
আসলে কাঁকড়া চাষের মাধ্যমে নিজের ভাগ্য বদলের স্বপ্নই দেখছেন আসাদুল। এমন স্বপ্ন দেখতেন তার বাবাও। তবে কাঁকড়া নয়, চিংড়িতে।
এ ইতিহাসের শুরু ১৯৮০'র দশকে। তখন থেকেই বাড়তে শুরু করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, বাড়ছিল জলোচ্ছ্বাস। এতে প্রতিনিয়ত নদীর কূল উপচে ফসলি জমিতে অনুপ্রবেশ শুরু করে নোনা পানি। নষ্ট হতে থাকে ক্ষেতের ফসল। এসময় আসাদুলের বাবাসহ উপকূলের লাখো চাষি ধান ক্ষেত লোনাপানিতে প্লাবিত করে- এসব ছোটবড় পুকুর বা ঘেরে ব্ল্যাক টাইগার প্রন প্রজাতির চিংড়ি চাষ শুরু করেন।
এতে সমর্থন দিয়েছিল তৎকালীন সরকারও। সরকারিভাবে চিংড়িকে রপ্তানির সম্ভাবনায় ভরপুর এক পণ্য হিসেবেও দেখা হয়। বেসরকারি সহায়তা সংস্থাগুলো ধান চাষ থেকে চিংড়ি চাষের রুপান্তরকে জলবায়ু সহনশীলতা তৈরির বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান হিসেবে প্রশংসা করে।
এভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৬ লাখ ৮০ হাজার একর জমিকে চিংড়ি চাষের আওতায় আনা হয়।
আসলে সেসময় মনে করা হয়েছিল, কৃষকেরা যেহেতু লোনা পানি ঠেকাতে পারছেন না, ফসলের ক্ষতি মাঝেমধ্যেই হচ্ছে- তাহলে লোনা পানিতে ক্ষেত ডুবিয়ে তাতে চিংড়ি চাষ করলে বরং বাড়তি দুই পয়সা রোজগার হবে। এই কৌশল একটা পর্যায় পর্যন্ত কাজেও এসেছিল। এসময় রপ্তানি বাজারে সফল হয়ে বাংলাদেশে 'সাদা সোনা' খ্যাতিলাভ করে চিংড়ি চাষ।
তবে মাত্র কয়েক দশক উচ্চ আয়ের রিটার্ন দেওয়ার পর দেখা দিতে থাকে বিপদ। প্রাকৃতিক পরিবেশের চরম বিপর্যয় তৈরি হয়; কয়েক দশক ধরে সেই দুরবস্থা আজো বহন করে চলেছে উপকূলের মানুষ। চিংড়ির ঘের নিয়ে খুন-জখমও নতুন কিছু নয়। এতে আরো প্রমাণিত হয়েছে জলবায়ুর সাথে ভুল উপায়ে মানিয়ে চলার চেষ্টা ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগ বাড়ায় বৈ কমায় না। এতে তারা দুর্যোগ মোকাবিলায় আরো দুর্বল হয়ে পড়ে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের ভূগোলবিদ কাসিয়া পাপরোকি। তিনি 'থ্রেটেনিং ডিসটোপিয়া: দ্য গ্লোবাল পলিটিক্স অব ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডাপশন ইন বাংলাদেশ' গ্রন্থেরও লেখক।
কাসিয়া বলেছেন, "চিংড়ি চাষকে এককালে জলবায়ু-পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে চলার কৌশল বলা হয়েছিল। যেসব এলাকা ইতোমধ্যেই পানিতে তলিয়ে গেছে, সেখানে একে একমাত্র উপায় বলে উল্লেখ করেছিল উন্নয়ন সংস্থাগুলো। অথচ যেসব সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা এড়ানোর জন্য এটি গ্রহণ করা হয়- এখন সেই সমস্যাগুলোই এটি তৈরি করছে।"
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন এবং আরো শক্তিশালী সাইক্লোনের আঘাত হানা, প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাস ও চরম তাপমাত্রার মতো নানান জলবায়ু বিপদ কবলিত বাংলাদেশ। এসব থেকে সুরক্ষিত থাকার চেষ্টাই যখন প্রাণান্তকর—ঠিক তখনই ব্যাপকহারে চিংড়ি চাষের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির শিকার হয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল।
কাঁকড়া চাষি আসাদুল ইসলাম থাকেন গাবুরা দ্বীপে। বঙ্গোপসাগরের কাছে খোলপেটুয়া নদী-বিধৌত এই দ্বীপ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন দিয়েও বেষ্টিত। জলবায়ু সংবেদনশীল দ্বীপটিতে বাস করে ৪০ হাজার মানুষ। ২০২০ সালের মে মাসে এখানে আঘাত হানে সাইক্লোন আম্ফান। এতে দ্বীপটির কিছু অংশ পরবর্তী ১৮ মাস ধরে লোনাপানিতে ডুবে ছিল।
এখন মানুষজন আবার তাদের মাটির ঘর মেরামত করছেন। আলকাতরা দিয়ে নৌকা নিশ্ছিদ্র করছেন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন পরবর্তী সাইক্লোন মৌসুমের। দ্বীপটির ক্রমে ক্ষয় হতে থাকা উপকূল রক্ষা বাঁধ সংস্কারে ১০৮ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে বাংলাদেশ সরকার। এই সংস্কার শেষ হলেও বাঁচার উপায় নেই গাবুরার, কারণ লোনাজল দ্বীপটিকে ভেতর থেকে বিষাক্ত করে রেখেছে।
গত তিন দশকে গাবুরার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি কৃষিজমিকে চিংড়ির ঘেরে রূপান্তর করা হয়েছে। এসব ঘেরকে ডাঙ্গার বুকে লোনাপানির মরুভূমি বলছেন বিশেষজ্ঞরা। চিংড়ি চাষ করতে গিয়ে এসব ঘেরে বিপুল পরিমাণ সার ও অন্যান্য রাসায়নিক দেওয়া হচ্ছে- এতে এগুলো হয়ে উঠেছে রোগব্যাধি উৎপত্তির আদর্শস্থল। যেমন- প্রাদুর্ভাব বেড়েছে হোয়াইট স্পট বাকুলোভাইরাসের। এটি চিংড়ির দেহে সরাসরি আক্রমণ করে। কোনো ঘেরে এর প্রাদুর্ভাব ঘটলে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে মারা পড়তে পারে সব চিংড়ি।
রোগব্যাধি সৃষ্ট লোকসান পুষিয়ে নিতে চাষিরা প্রায়ই ঘের পুকুরে বেশি বেশি চিংড়ির রেণু ছাড়েন। কিন্তু এ কৌশল অটেকসই।
আসাদুল ইসলাম জানান, "১০ বছর আগে প্রথম এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। অনেক চিংড়ি তাতে মারা পড়ে। ক্ষতি পোষাতে আগে যে পরিমাণ জায়গায় আমরা ৫০০ চিংড়ি চাষ করতাম- সেখানে পরে ১,০০০ এবং পরের বার ৩,০০০ পর্যন্ত চিংড়ি ছেড়েছি।"
কিন্তু, বেশি চিংড়ি একই পরিমাণ জায়গায় রাখায় রোগ-ব্যাধিও দিন দিন প্রকট হচ্ছে। চিংড়ি চাষিদের সাথে অন্য কৃষকদের বিরোধ সামাজিক অশান্তি বৃদ্ধি করছে।
কৃষকদের অভিযোগ, ঘেরের লোনা পানি চুইয়ে আসছে তাদের ক্ষেতে। পরিবেশবিদরাও বলছেন, চিংড়ির ঘেরে দেওয়া খাদ্য ও সার স্থানীয় জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করছে। স্থানীয় বেকার মানুষের অভিযোগ, ধান উৎপাদনে যে পরিমাণ শ্রমিক দরকার হয়, তার চেয়ে সামান্য অংশই দরকার হয় ঘেরে। এলাকার ক্ষুধার্ত মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখে, এককালে যে জমি তাদের অন্নের সংস্থান করতো তা এখন রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
প্রভাবিত হয়েছে খাবার পানিও, উপকূলীয় বাংলাদেশের ৫০ শতাংশের বেশি ভূগর্ভস্থ পানির জলাধারকে দূষিত করেছে লবণের অনুপ্রবেশ। এজন্য সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাস অনেকাংশে দায়ী হলেও, লোনা পানিতে অ্যাকুয়াকালচার কৃষিও দায়ী।
গাবুরায় মিঠাপানি উত্তোলনে সক্ষম গভীর নলকূপের সংখ্যা মাত্র একটি। এজন্য খাবার পানি, গোসল ও কাপড় ধোয়া ইত্যাদি কাজে ব্যবহারের জন্য বৃষ্টির পানি ধরে রাখে এমন ছয়টি পুকুরের ওপর নির্ভরশীল এলাকাবাসী। ২০১৯ সালের এক সরকারি গবেষণার তথ্যমতে, এসব পুকুরের মধ্যে তিনটি ব্যবহার হচ্ছিল অ্যাকুয়াকালচারে। আর নিরাপদ খাবার পানি মিলতো মাত্র একটি পুকুর থেকে।
মিঠাপানির সংকট নারীদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে, বেড়েছে তাদের লিঙ্গবৈষম্য। যেসব এলাকায় উচ্চ লবণাক্ততা রয়েছে, সেখানকার নারী ও কন্যা শিশুদের পরিবারের জন্য খাবার পানি সংগ্রহে কমপক্ষে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে যেতে হয়।
বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়নশীল একটি দেশ। লোনাপানিতে মৎস সম্পদ চাষ অর্থনীতিতে অবদানও রাখছে। করোনা মহামারির বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ার আগে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ৩০ হাজার টন চিংড়ি রপ্তানি করেছে, যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার।
কাসিয়া পাপরোকি জানান, ১৯৮০'র দশক থেকে উন্নয়ন সংস্থাগুলো উপকূলীয় এলাকার মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণের উপায় হিসেবে চিংড়ি চাষকে উৎসাহিত করেছে। অথচ এর সামাজিক উদ্বেগগুলিকে তারা পরোয়া করেনি। আর এখন গবেষণা বলছে, এতে দারিদ্র্য দূরীকরণে খুব সামান্যই অবদান যোগ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শিল্প থেকে সিংহভাগ আয়ের সুবিধা পাচ্ছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মধ্যস্বত্বভোগী ও ধনী জমি মালিকেরা।
স্থানীয়ভাবে প্রায়ই এই গোষ্ঠীকে বলা হয়- চিংড়ি মাফিয়া। এই বাণিজ্যের আধিপত্য ধরে রাখতে তারা প্রায়ই হুমকিধামকি ও বলপ্রয়োগ করে।
এমন মারাত্মক এক ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন গাবুরা থেকে ৪০ মাইল উত্তরের এক গ্রামবাসী ও কৃষক তপন গোয়ালদার। তিনি জানান, ১৯৯০ এর দশকে স্থানীয় এক ধনী ব্যবসায়ী গুণ্ডাপাণ্ডা ভাড়া করে এনে জোরপূর্বক একটি বাঁধ কেটে দিতে আসে। ওই এলাকার কৃষিজমি যাতে লোনাপানিতে ভেসে যায় এবং সেগুলো যাতে দখল করে চিংড়ি চাষ করা যায়- সেজন্যই এ চেষ্টা করে ওই ব্যক্তি।
তপন বলেন, "আমরা জোর প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। আমরা আমাদের গাছ, ভূমি, মিঠাপানির পুকুর- আমাদের সর্বস্ব জীবিকা এভাবে ধ্বংস হতে দিয়ে চাইনি।"
দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের সময় গুণ্ডারা একজন নারীকে হত্যা করে। তারপরও তপন গোয়ালদারসহ অন্য কৃষকেরা প্রতিরোধ চালিয়ে যান। তাদের প্রতিরোধের কারণেই আজো গ্রামটির মাঠে মাঠে সবুজ ধানগাছের দেখা মিলে। দেখা যায়, চোখজুড়ানো সবজি বাগানও।
উপকূলের অন্যান্য এলাকাতেও এ ধরনের প্রতিরোধ হয়েছে। কিন্তু, দুর্ভাগ্য গাবুরার। এখানকার উপকূল রক্ষাবাঁধের অনেক জায়গায় ফাটল রয়েছে, কিছু জায়গায় পাইপের মাধ্যমে লোনাপানি টেনে নিচ্ছে চিংড়ি ঘেরের মালিকেরা। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানেও দুর্বল হয়েছে দ্বীপ রক্ষাবাঁধ।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রকৌশলী জানান, বাঁধ পুনর্নিমাণের সময় স্থানীয়দের সাথে সংঘাত এড়াতে চিংড়ির ঘেরগুলোকে নির্দিষ্ট এলাকাতে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
তবে দুর্নীতি-বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তদন্তে উঠে এসেছে, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা প্রায়ই উপকূল রক্ষা বাঁধ কাটার মীমাংসায় চিংড়ি চাষিদের পক্ষ নেন। ২০২০ সালে প্রকাশিত সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, "একারণে এখনও অবৈধভাবে বাঁধ কাঁটার ঘটনা ঘটছে।"
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান