জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় কর্মঘন্টা কমানো ও হোম অফিস চালুর পরিকল্পনা সরকারের
ক্রমে খারাপের দিকে যেতে থাকা জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় এখন কঠোর পদক্ষেপের কথা ভাবছে সরকার।
অফিসের সময় কমিয়ে, বাড়ি থেকে কাজ করার পদ্ধতি পুনরায় চালু এবং আলোকসজ্জা নিষিদ্ধ করার মতো পদক্ষেপগুলিই সরকারের জ্বালানি সাশ্রয়ের পরিকল্পনায় রয়েছে, যা জ্বালানি আমদানির খরচ হ্রাস করে অর্থনীতির ওপর চাপ কমাবে।
বৃহস্পতিবার (৭ জুলাই) বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টার, শপিংমল, লোকানপাট, অফিস ও বাসাবাড়িতে আলোকসজ্জা না করার জন্য নির্দেশ জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানির দাম ক্রমেই বাড়ছে, যা দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছে। এ বাস্তবতায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ও বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর নির্দেশনা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য সপ্তাহিক কর্মঘণ্টা কমানো এবং ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম (বাড়ি থেকে দাপ্তরিক কাজ) বাস্তবায়ন করতে জনপ্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগকে সুপারিশ করবে মন্ত্রণালয়টি। একইসঙ্গে অফিসে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রীর নিচে না করাসহ মসজিদের মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে এসি ব্যবহার সীমিত রাখা বাধ্যতামূলক করা হতে পারে। সামাজিক অনুষ্ঠান সন্ধ্যারাত ৭টার মধ্যে শেষ করতে হবে।
দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে এক বৈঠকের পর বৃহস্পতিবার (৭ জুলাই) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব পদক্ষেপের কথা জানান প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। তিনি মনে করেন, সাশ্রয়ী পদক্ষেপ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে বিদ্যুতের চাহিদা ২,০০০ মেগাওয়াট কমানোর যাবে।
গত বুধবার বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৩,৭২৮ মেগাওয়াটে পৌঁছায়, সে তুলনায় সর্বোচ্চ সরবরাহ ছিল ১৩,২২৮ মেগাওয়াট।
এই বাস্তবতায় সরকারের পদক্ষেপগুলি এখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় যোগ দেওয়া বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন যে, তারা চান সরকার ঈদুল আজহার ছুটির পর এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করুক।
বিশেষজ্ঞরাও এসব পদক্ষেপকে সময়োচিত বলছেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে চাপ তৈরি হয়েছে। এই ক্ষেত্রে, সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোক্তা সকলেরই সাশ্রয়ী পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। এখানে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের যৌক্তিকতা রয়েছে।'
একইসঙ্গে জ্বালানি খাতে সুশাসনের দুর্বলতাগুলিও খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মনে করছেন তিনি।
কোভিড-১৯ সংক্রমণের সর্বোচ্চ সময়ে দেশের অফিস কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের মুহূর্তে কাজের এই মডেল বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার।
বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি সচল রাখতে এলএনজি আমদানিতে দেওয়া হচ্ছে ২৫ হাজার কোটি টাকা।
তিনি আরও জানান, তার সরকার নতুন অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ৮৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। তবে জ্বালানি ব্যবহার কমানো না হলে, ভর্তুকির অঙ্ক আরও বাড়বে।
"আমরা যদি ভর্তুকি না কমাই, তাহলে সরকার এত টাকা কোথা থেকে পাবে?"- বলেন তিনি।
এসব প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, বিশ্ব পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল নাহলে- আমরা চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারতাম।
জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, "রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের দেওয়া নিষেধাজ্ঞায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামের অস্থিরতা আমাদের শেষ সীমায় নিয়ে গেছে। সরকারকে এখন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বিপুল ভর্তুকির ভারবহন করতে হচ্ছে।"
"আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ঘাটতি এখানেই শেষ হবে। পরিস্থিতি কোন দিকে যায় আমাদের সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের সবার সম্মিলিত চেষ্টায় এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে"- যোগ করেন তিনি।
তৌফিক-ই-ইলাহী জানান, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা ১৪,৫০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হতে পারে। কিন্তু উল্লেখিত পদক্ষেপগুলির মাধ্যমে চাহিদা ১২,৫০০ মেগাওয়াটে কমিয়ে আনা সম্ভব।
এদিকে, এক অডিও বার্তায় জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তেল-গ্যাস ব্যবহারে সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, সরকারকে কোনো না কোনো সময় বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানির দাম সমন্বয় করতে হবে। .
"বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম গত ৬-৭ মাস ধরে বেড়েই চলেছে৷ আমরা যে (অপরিশোধিত) তেল ব্যারেলপ্রতি ৭০-৭১ ডলারে কিনতাম, তা এখন ১৭১ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি যে, জ্বালানির দাম সমন্বয় করতে হবে। বর্তমানে সরকার নিজস্ব বরাদ্দ থেকে ভর্তুকি দিচ্ছে। এর পরেও, আমি মনে করি আমাদের এক পর্যায়ে দাম সমন্বয় করতেই হবে।"
ভারতের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ক্রমবর্ধমান জ্বালানির দাম মোকাবিলায় নানান রকম ব্যবস্থা নিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কথাই যদি বলি, তারা বিভিন্ন তেলের ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি ৩৫ থেকে ৫০ টাকা বাড়িয়েছে।
চলমান বিদ্যুৎ সংকটের কথা বলতে গিয়ে নসরুল হামিদ বলেন, "এই পরিস্থিতি সাময়িক। আমাদের প্রচুর বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। গ্যাসের সংকটের কারণে আমরা উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছি।"
"আমরা সার কারখানা এবং অন্যান্য শিল্পে গ্যাস সরবরাহকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। যদি আমরা সবাই গ্যাস ব্যবহারে মিতব্যয়ী হয়ে উঠি, তাহলে আমি আত্মবিশ্বাসী- যে আমরা এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারব"- যোগ করেন প্রতিমন্ত্রী।