মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বসবাস!
গত সোমবার ভোরে মৃত্যু সংবাদ শুনে ঘুম ভাঙে সিলেটবাসীর। সিলেটের জৈন্তাপুরে টিলা ধসে মারা যান একই পরিবারের ৪ জন। আহত হন আরও ৫ জন।
টিলার ঢালেই ছিলো ওই পরিবারের বসত। অতিবৃষ্টিতে সোমবার ভোরে টিলা ধসে পড়ে বাড়ির উপর। এতে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যায় বাড়িটি। হতাহত হত বাড়ির বাসিন্দারা।
শুধু জৈন্তাপুরের ওই একটি বাড়িই নয়, সিলেটে পাহাড়-টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন এমন অনেকেই। সরকারিভাবে এদের কোন তালিকা নেই, তবে বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বসাবস করছেন তারা। জৈন্তাপুরের যে ইউনিয়নে সোমবার প্রাণহানির ঘটনা ঘটে, সেই চিকনাগুলেই টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বাস করে আরও ২৫টি পরিবার। প্রতিবছরই বর্ষায় টিলা ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তবু তাদের পুনর্বাসনে এখন পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ নেই।
যদিও ২০১২ সালে সিলেটের পাহাড় টিলা সংরক্ষণে উচ্চ আদালতের এক রায়ে টিলার উপর ও পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেয়া হয়।
সোমবার জৈন্তাপুরের দুর্ঘটনার আগেই রোববার ভোরে ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়া এলাকার একটি টিলা ধসে ঢালের চারটি ঘরের উপর পড়ে। এতে কোন প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও ওই চারটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার আগে গত ১৪ মে গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষনাবন্দে টিলা ধসে মারা যান অপু লাল রায় নামে একজন এনজিও কর্মী। লক্ষনাবন্দের চক্রবর্তী পাড়ার একটি টিলার পাদদেশেই ঘর ছিলো অপুদের। প্রতিবছরই টিলা ধসে এমন প্রাণহানি ঘটে সিলেটে।
সিলেট নগরের হাওলাদারপাড়া এলাকার একটি টিলার নাম জাগো টিলা। উঁচু এই টিলার একেবারে কিনারা ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে কয়েকটি ঘর। উপরের ঘরগুলোর ঠিক নিচে, টিলার পাদদেশেও ঘর রয়েছে কয়েকটি। টিলার উপরে ও ঢালে বসবাস করা সবগুলো পরিবারের বাসিন্দারাই রয়েছেন ঝুঁকিতে। প্রাণের শঙ্কা নিয়েই বছরের পর বছর ধরে তারা বসবাস করে আসছেন এখানে।
জাগোটিলার উপর ঘর বানিয়ে বাস করা শামসুল ইসলাম বলেন, এটি সরকারি টিলা। ভাড়া দিতে হয় না। তাই আমরা এখানে ঘর বানিয়ে থাকি।
ঝুঁকি সম্পর্কে তিনি বলেন, 'ভয় তো আছেই। বৃষ্টিতে ভয় আরও বেড়ে যায়। কিন্তু আমরা গরিব মানুষ। জায়গা কেনার সামর্থ নেই। ঘর ভাড়া করাও অনেক খরচের। তাই ঝুঁকি নিয়েই এখানে থাকি।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টিলার উপরে ও পাদদেশে বসবাসকারী বেশিরভাগ লোকজনই এরকম দরিদ্র। স্থানীয় প্রভাবশালীরা টিলা কাটা ও দখলের জন্য দরিদ্রশ্রেণির লোকজনদের বসিয়েছেন। আবার কম টাকায় পেয়ে টিলার পাদদেশে জমি কিনেও ঘর বানিয়েছেন অনেকে। সোমবার জৈন্তাপুরে নিহত পরিবারও টিলার পাদদেশে জমি কিনে ঘর তুলেছিলো।
পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্টর প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই বলেন, 'আমরা বছর তিনেক আগে একটা জরিপ চালিয়ে দেখেছিলাম জেলায় টিলার পাদদেশে প্রায় ১০ হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছেন। এখন এই সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে।'
তিনি বলেন, বসবাসের জন্য এসব টিলার অনেকাংশ কেটে ফেলায় টিলাগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে এগুলো ধসে পড়ে প্রাণহাণির ঘটনা ঘটে।
অপরিকল্পিতভাবে টিলা কাটা, বৃক্ষ উজার ও টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসের ফলে বৃষ্টি হলেই টিলা ধসে পড়ছে বলে মত এই পরিবেশকর্মীর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের হাওলাদারপাড়া, আখালিয়া, পীরমহল্লা ব্রাহ্মণশাসন জাহাঙ্গীরনগর, তারাপুর চা বাগান এবং নগরের উপকণ্ঠের বালুচর, বিমানবন্দর সড়ক, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর, জোনাকী, ইসলামপুর মেজরটিলা, মংলিরপাড় এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েকশ পরিবার। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার।
ঠিক কী পরিমাণ লোক টিলার উপর ও পাদদেশে বসবাস করেন এমন তথ্য নেই জানিয়ে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল বশিরুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের উপজেলায় কয়েকটি ইউনিয়নে এরকম টিলার পাদদেশে লোকজন বসবাস করেন। আমরা বর্ষা শুরুর আগেই তাদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করিয়েছি। ইউনিয়ন পরিষদেও চেয়ারম্যানদের দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছি। তবু তারা সরে যাননি।'
ইউএনও বলেন, 'জৈন্তাপুরে আগে এমন দুর্ঘটনা ঘটেনি। তাই ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের কোন তালিকা করা হয়নি আমাদের। তাদের নিরাপদ জায়গায় সরানো বা পুনর্বাসনেরও কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এখন এ ব্যাপারে ভাবতে হবে।'
তবে এসব প্রাণহানির জন্য প্রশাসনের গাফিলতিকে দায়ী করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, '২০১২ সালে আমাদের করা একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত সিলেটে পাহাড় টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। একই সঙ্গে পাহাড় টিলা সংরক্ষণ ও তার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষজনকে পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেন। কিন্তু ওই রায়ের ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়নি।'
শাহেদা বলেন, 'কী পরিমান লোক ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করেন তারও কোন হিসেব নেই জেলা প্রশাসনের কাছে। তাদের পুনর্বাসন বা টিলা সংরক্ষণে সরকারি কোন উদ্যোগ বা প্রকল্প নেই। বরং টিলা ধ্বংস করে অনেক প্রকল্প আছে। সরকারের এই নিষ্ক্রিয়তার কারণেই বারবার এই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে।'
এই পরিবেশকর্মী আরও বলেন, 'বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টিলাখেকোরা টিলা দখল ও কাটার জন্য দরিদ্রশ্রেণির লোকজনকে স্বল্পভাড়ায় বা বিনাভাড়ায় টিলার উপরে ঘর নির্মাণ করে দেয়।'
টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাকারীদের সরানো যায় না এমন দাবি সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমানের। তিনি বলেন, 'টিলার উপরে ও পাদদেশে যারা বসবাস করেন তাদের অনেকেই নিজের জমিতে ঘর বানিয়ে থাকেন। চেষ্টা করেও তাদের অন্যত্র সরানো যায় না। এবছরও আমরা সব ইউএনওদের মাধ্যমে মাইকিং করিয়ে টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যেতে বলেছি। কিন্তু কেউ কথা শুনেনি।'
তিনি বলেন, 'এটা একটা বড় সমস্যা। তাদের কিভাবে সরানো ও পুনর্বাসন করা যায় এ নিয়ে ভাবছি। এ বিষয়ে পরিকল্পনা নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেবো। তাদের মধ্যে যদি কেউ ভূমিহীন থেকে থাকেন তাহলে প্রশাসন বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের সরকারের আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হবে।'