২ মাসের মধ্যে রামগড় স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শুরু হবে
আগামী দুই মাসের মধ্যে খাগড়াছড়ির রামগড় স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম চালু হতে যাচ্ছে। স্থলবন্দরের স্থায়ী কাঠামো তৈরী নিয়ে জটিলতার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় অস্থায়ী কাঠামোয় ইমিগ্রেশন কার্যক্রম চালু করবে কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বন্দর দিয়ে ইমিগ্রেশন চালু হলে বাংলাদেশি নাগরিকদের ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে যাতায়াত সহজ হয়ে আসবে।
প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হলে বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হবে বলেও জানান তারা।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রায় ১১২ কিলোমিটার দূরত্বের এই স্থলবন্দর ব্যবহার করে মাত্র ৩ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্য যেতে পারবে ভারতে। দেশটির উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যসহ মেঘালয়, আসাম, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচলের তথা সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে।
একই সঙ্গে রামগড় স্থলবন্দর ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে পণ্য পরিবহন করতে পারবেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। বাড়বে দুই দেশের বাণিজ্য। এই বন্দর দিয়ে ভিসা নিয়ে দুই দেশে যাতায়াত করা যাবে।
স্থলবন্দরের কাজ চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্থায়ী কাঠামো তৈরি নিয়ে জটিলতার জেরে দেরি হওয়ায় কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের আগেও ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শুরু করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছে।
২০২১ সালের শুরুতে ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়ে ফেনী নদীর ওপর নির্মিত বাংলাদেশ-ভারত প্রথম মৈত্রি সেতু-১ উদ্বোধন করেন।
রামগড় স্থলবন্দরের প্রকল্প পরিচালক মো. সারওয়ার আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা সীমান্তের 'শূন্যরেখা'র ১৫০ গজের বাইেরে যে জায়গা আছে সেখানে অস্থায়ী স্থাপনা তৈরির মাধ্যমে বন্দরের ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শুরুর চেষ্টা করছি। আশা করছি, আগামী দুই মাসর মধ্যে বন্দরের কাজ চালু করতে পারবো।'
'রামগড় স্থলবন্দর প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুনে শেষ হয়ে গেছে। আমরা আরও এক বছর মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আবেদন করেছি, তবে মনে হচ্ছে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করতে আরও বেশি সময় লাগবে।
তবে ভারতও যেহেতু এ বন্দর নিয়ে খুব আগ্রহী, তারা নিজেদের টাকায় সেতু ও সড়ক করে দিয়েছে। তাই খুব শীঘ্রই আমরা বন্দরের সুফল পেতে যাচ্ছি।'
২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর ভারত এবং বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে বাংলাদেশের দুটি সমুদ্রবন্দর- চট্টগ্রাম এবং মংলা ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়ার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
চুক্তির আওতায় ২০২০ সালের ২২ জুলাই চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে চারটি কন্টেইনারে করে ৫৩.২৫ মেট্রিক টন রড ও ৪৯.৮৩ মেট্রিক টন ডাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আখাউড়া স্থলবন্দরে পৌঁছায়।
পরদিন ২৩ জুলাই আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে পরীক্ষামূলক প্রথম চালান হিসেবে আগরতলায় পৌঁছে কন্টেইনার চারটি।
এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালামাল পরিবহন করে ভারত সরকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্দরটি চালু হলে পরিবর্তন হবে উত্তর চট্টগ্রাম ও পাহাড়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থার।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আলমগীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রামগড় স্থল বন্দরকে কেন্দ্র করে পুরো চট্টগ্রামের দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। বন্দরকে কেন্দ্র করে সড়ক সংস্কার হতে শুরে করে একাধিক বড় সেতু ও সড়ক নির্মাণ হচ্ছে। রামগড়ের এ বন্দরে স্থানীয় মানুষদের জীবনযাত্রার মান অভাবনীয় পরিবর্তন হবে।'
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে পরিবহন সংযোগের উন্নতির ফলে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ১৭২ শতাংশ এবং ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ২৯৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ভারতের ট্রান্সশিপমেন্টের কার্গো পরিবহনের সক্ষমতা চট্টগ্রাম বন্দরের আছে। আগামী ২১ জুলাই পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালও চালু হয়ে যাচ্ছে। তবে ভারতের কি পরিমান কার্গো আমরা পাচ্ছি তা নির্ভর করবে সে দেশের ব্যবসায়ীরা কখন কত কার্গো দিতে পারছেন তার ওপর।
ভারত তাদের নিজস্ব বা বাংলাদেশি জাহাজ ব্যবহার করে ট্রান্সশিপমেন্টের মালামাল গুলো আনা-নেওয়া করতে পারবেন। এক্ষেত্রে রামগড় অপেক্ষাকৃত কাছে হওয়ায় ভারতীয় ব্যবসায়িরা এটি ব্যবহারে বেশি উৎসাহি হবে বলে আশা করছি।'
বিজিএমইএর সহ-সভাপতি ও উত্তর চট্টগ্রামের বাসিন্দা রাকিবুল আলম চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এ বন্দরের সরচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো। তারা সহজে ও কম খরচে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহনের সুবিধা দেবে।
এর মাধ্যমে বাংলাদেশি ব্যবসায়িরাও রপ্তানির একটি নতুন দ্বার পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সহজে ভারত থেকে পশুসম্পদ, ফল, কাঠ, বীজ, গম, পাথর, কয়লা, সার ইত্যাদি আমদানি করতে পারবে। সর্বপরি এ বন্দর উত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বয়ে আনবে; বিকশিত হবে পাহাড়ের পর্যটন শিল্প।'
খাগড়াছড়ির স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শরণার্থী পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ভারতের সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষের শত বছরের সম্পর্ক। বৈধ কোনো রুট না থাকায় মানুষ অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার করতো। এখন বৈধ উপায় তৈরী হলে মানুষের দুর্ঘব লাঘব হবে।
পাশাপাশি রামগড় স্থল বন্দরকে ঘিরে ইতোমধ্যে খাগড়াছড়িতে জমির দাম কয়েকগুন বেড়ে গেছে। এছাড়া পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। স্থল বন্দরটি চালু হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি দুই দেশের বাণিজ্যিক, পর্যটন ও যোগাযোগ সর্ম্পক সুদৃঢ় হবে।'
প্রকল্প পরিচালক মো. সারওয়ার আলম জানান, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থলবন্দরটি নির্মাণ করা হবে। তবে প্রয়োজনে এ ব্যয় আরও বাড়তে পারে।
প্রকল্পের আওতায় আর্ন্তজাতিক মানের একটি পেসেঞ্জার টার্মিনল ভবন নির্মাণ করা হবে। এ টার্মিনাল ভবনের অভ্যন্তরে বিজিবি চেকপোস্ট, কাস্টমস, ইমিগ্রেশন অফিস থাকবে। এছাড়া ওয়ান স্টপ সার্ভিস সিষ্টেমে একই ভবনে সব ধরণের চেকিং সম্পন্ন করে বহিঃগমন এবং প্রবেশ করবেন যাত্রীরা।'
এ বন্দর চালুর লক্ষে খাগড়াছড়ির রামগড়ে মহামুনি এলাকায় ফেনী নদীর উপর ৪১২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৪. ৮০ মিটার প্রস্থ মৈত্রিসেতু-১ নামে একটি আন্তর্জাতিক সেতু নির্মাণ করা হয়। এতে খরচ হয়েছে ১৩৩ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ৮৪৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ব্যায়ে চট্টগ্রামের বড়ইয়ারহাট থেকে রামগড় স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়ক প্রশস্ত করার কাজ চলছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ভারত দিচ্ছে ৫৮১ দশমিক ২০ কোটি টাকা। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকার নিজ তহবিল থেকে দিচ্ছে।
এছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় নয়টি সেতু ও ২৩টি কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার অর্থায়নে নির্মাণ হচ্ছে আটটি সেতু ও আটটি কালভার্ট।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রামগড় স্থলবন্দরের দুরত্ব প্রায় ৯৬ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম শহরের উপর দিয়ে হাটহাজারী হয়ে রামগড় যেতে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টার কাছাকাছি। বড়ইয়ারহাট-রামগড় সড়কটি চালু হলে সে দুরত্ব আড়াই ঘণ্টায় নেমে আসবে।
চট্টগ্রামের সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সৌম্য তালুকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রকল্পের আওতায় ৩৮ কিলোমিটার সড়কটি ৫ দশমিক ৫ মিটার থেকে ৭ দশমিক ৩ মিটার প্রশস্ত করা হবে। নানা জটিলতায় এখনো সে কাজ শুরু করা যায়নি। তবে ভূমি অধিগ্রহণসহ আনুষাঙ্গিক কাজ চালু আছে। কাজ শেষ হতে আরও দুই বছর সময় লাগবে, কাজ শেষ হলে সড়কটি উভয় দেশের যোগাযোগ খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।'