ঢাকার ট্রাফিক পুলিশ বক্সই এখন পথচারীদের চলাচলে অন্তরায়
রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে ফুটপাত ও সড়কে ক্রমশ বাড়তে থাকা ট্রাফিক পুলিশ বক্স পথচারীদের জন্য নতুন এক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে থাকার চেয়ে মানুষ প্রায়ই তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে হেঁটে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরের ফুটপাতে ট্রাফিক বক্সের মতো এসব স্থাপনা আসলে মানুষের দুর্ভোগই বাড়ায়।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ জানায়, তাদের হিসাব অনুযায়ী রাজধানীতে ট্রাফিক বক্স রয়েছে ১০৭টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪৫টি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে ৬২টি। এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক বক্স তৈরি করা হয়েছে।
সবমিলিয়ে ঢাকায় ট্রাফিক বক্সের সংখ্যা দেড় শতাধিক হবে।
সম্প্রতি রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের অন্তত ৪০টি স্থানের পুলিশ বক্স ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার মধ্যে ১১টি, ফুটপাতে ১৭টি এবং ডিভাইডারের উপর ১২টি পুলিশ বক্স স্থাপন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১২টি স্থায়ী ভবন হিসেবে নির্মাণ করা এবং বাকি ২৮টি অস্থায়ী বক্স।
রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডের ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী শিহাবসহ বেশ কয়েকজন। কিন্তু এখানে ফুটপাতের উপর নির্মিত ট্রাফিক পুলিশ বক্সের কারণে ঐ অংশ পার হতে মেইন রাস্তায় নামতে হয়। একদিকে ফুটপাতের অর্ধেকেরও বেশি অংশ দখল করে বানানো হয়েছে ফুটওভার ব্রিজ এবং বাকি অংশটুকুতে পুলিশ বক্স।
শিক্ষার্থী শিহাব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ফুটপাতে আমরা স্বাচ্ছন্দে হাঁটতে পারি না। বিশেষ করে কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড পার হতে গিয়ে মেইন রাস্তা দিয়েই হেঁটে যেতে হয়। পুলিশ বক্সের কারণে ফুটপাত দিয়ে হাঁটা যায় না।"
শুধু কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডেই নয়, রাজধানীর ১৫০টিরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারসেকশন এবং রাস্তার পাশে ট্রাফিক পুলিশের জন্য স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছে পুলিশ বক্স। যার অধিকাংশই হয় ফুটপাত দখল করে কিংবা রাস্তার মধ্যে কিংবা রাস্তার ডিভাইডারের উপর তৈরি করা হয়েছে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, উন্নত দেশে ফুটপাতে পুলিশ বক্স তৈরি করা হলেও সেটা সিটি করপোরেশনের সাথে সমন্বয় করে তৈরি করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ কাজে কোনো সমন্বয় নেই।
তিনি বলেন, "যেখানে ট্রাফিক পুলিশ যান রাস্তায় যান চলাচল নির্বিঘ্ন করবে সেখানে তারাই যদি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সেটা ভালো কাজ নয়। এমনকি অনেক স্থানে পুলিশ বক্সের কারণে ড্রাইভারদের রাস্তা দেখতেও সমস্যা হয়।"
"সরকারি জায়গায় কিংবা ফুটপাতেই পুলিশ বক্স করতে হবে বিষয়টি এমনভাবে না নিয়ে সুবিধাজনক স্থানে এগুলো করা যেতে পারে। পুলিশ বক্সগুলো বর্গাকারে তৈরি করা হয়, কিন্তু ফুটপাতের সাথে সমন্বয় করে যদি লিনিয়ার আকারে করা যায় তাতেও সমস্যা কম হয়। দরকার হলে ইন্টারসেকশনের পাশে জায়গা কিনে কিংবা ভাড়া নিয়েও এটা করা যেতে পারে। এজন্য কাজে সমন্বয় থাকাটা জরুরি," যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান টিবিএসকে বলেন, "এ সমস্যার সমাধান বের করার বিষয়ে কেউ ভাবছে না। পুলিশ মনে করে তারা যেখানে ইচ্ছা সেখানে বক্স তৈরি করে ফেলতে পারেন।"
তিনি বলেন, "নির্ধারিত জায়গার বাইরে গিয়ে যদি কেউ স্থাপনা করে সেটা ভেঙ্গে দিতে হবে। সেটা পুলিশ কিংবা, বিজিএমইএ, সেনাবাহিনী যেই হোক না কেন। ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করতে হলে অনেকেরই আচরণে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।"
ঢাকার মোড়ে মোড়ে ফুটপাতে এবং রাস্তার ডিভাইডারে স্থাপিত পুলিশ বক্সগুলো নিয়ে ডিএমপি ও দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে গত কয়েক বছর ধরে আলোচনা চললেও এখনও কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায়নি।
ডিএমপি বলছে, পুলিশ বক্সের ব্যবস্থা নতুন কোনো বিষয় না। আইনগতভাবে এবং ট্রাফিক পুলিশের জন্য মানবিক কারণে বেশ কয়েক বছর আগে শহরের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ বক্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের শহরগুলোর মতো করেই ফুটপাতে এসব পুলিশ বক্স নির্মাণ করা হয়েছে।
এ নিয়ে দুই সিটি করপোরেশনের সাথে তাদের আলোচনা চলমান আছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ডিএমপিকে কয়েকটি স্থান দিয়ে সহযোগীতা করলেও উত্তর সিটি তা দেয়নি বলে জানান তারা।
দুই সিটি কর্পোরেশন বলছে, পথচারী ও যান চলাচলে সমস্যা হয় এমন কোনো স্থাপনা ফুটপাত কিংবা রাস্তার উপর করা যাবে না। পুলিশ বক্স স্থাপন নিয়ে ডিএমপির সাথে নিয়মিত আলোচনা হচ্ছে বলেও জানান তারা। ডিএমপির চাহিদা অনুযায়ী জায়গা দিতে চেষ্টা করছে দুই সিটি কর্পোরেশন।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগর উন্নয়নের যেসব পরিকল্পনা রয়েছে, তা পুরোপুরি না মেনেই এসব পুলিশ বক্স নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারের জমি না থাকলে দরকার হলে জমি কিনে কিংবা ভাড়ায় নিয়ে পুলিশ বক্স স্থাপনের পরামর্শ তাদের।
যারা এসব জায়গা অবৈধ দখল মুক্ত রাখতে কাজ করবে বা আইন রক্ষা করবে, তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ কেন উঠবে এমন প্রশ্নও তাদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কারওয়ানবাজার সার্ক ফোয়ারা, মিরপুর-১০, মিরপুর-১, ফার্মগেট মোড়, খামাড়বাড়ি মোড়ের পুলিশ বক্সগুলো রাস্তার মধ্যেই স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ফুটপাত দখল করে পুলিশ বক্স বানানো হয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মোড়, আগারগাঁও মোড়, মিরপুর-১ সনি সিনেমা হল মোড়, শ্যামলী স্কয়ারের সামনে, শিশুমেলাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে।
রাস্তার ডিভাইডারে পুলিশ বক্স বানানো হয়েছে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, খেজুর বাগান মোড়, কারওয়ান বাজার মসজিদের পাশে ছাড়াও বেশ কয়েকটি স্থানে।
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে শাহবাগ মোড়, বাংলামোটর, পরিবাগ, মৎস্য ভবন মোড়সহ বেশ কয়েকটি স্থানে রাস্তার মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে পুলিশ বক্স। এছাড়া ফুটপাতের উপর পুলিশ বক্স রয়েছে দিলু রোডের মোড়, জাতীয় প্রেসক্লাব, মতিঝিল শাপলা চত্বর, কমলাপুর, শাহজাহানপুরসহ বেশ কয়েকটি স্থানে। কাকরাইল মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, মালিবাগ মোড়, মগবাজার মোড়সহ বেশ কয়েকটি স্থানে রাস্তার ডিভাইডারের উপর স্থাপন করা হয়েছে পুলিশ বক্স।
এসব স্থানে চলাচলকারী লোকজনের সাথে কথা বললে তারা জানান, পুলিশ বক্সের কারণে তাদের ফুটপাত থেকে নেমে রাস্তা দিয়ে ঐ অংশ পার হতে হয়। এতে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনারও সম্মুখীন হচ্ছে পথচারীরা।
যেসব ইন্টারসেকশনে রাস্তার মধ্যে পুলিশ বক্স স্থাপন করা হয়েছে সেখানে গাড়ি চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। অনেক স্থানে ডিভাইডারের প্রস্থের চেয়ে বাড়তি জায়গা নিয়ে পুলিশ বক্স স্থাপন করায় রাস্তার প্রস্থ কমে গিয়েও সৃষ্টি হয়েছে সমস্যা।
বাসের ড্রাইভার ইলিয়াস হোসেন টিবিএসকে বলেন, খামারবাড়ি মোড়ে দুটি পুলিশ বক্সই রাস্তার মধ্যে। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে সংযুক্ত সড়কটির পূর্বদিকের প্রবেশ মুখে রাস্তার মাঝ বরাবর তৈরি করা ট্রাফিক পুলিশ বক্স যেমন দৃষ্টিনন্দন সড়কটির সৌন্দর্য্য নষ্ট করেছে তেমনি পুলিশ বক্সের স্থানটি চওড়া হয়ে যাওয়ায় রাস্তার প্রস্থ কমেছে। এতে তাদের টার্নিং নিতে সমস্যা হয়।
শনিবার (২৩ জুলাই) রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সামনের ফুটপাতে অবৈধভাবে নির্মিত পুলিশ বক্সের একটি স্থায়ী ভবন ও পুরনো একটি অস্থায়ী পুলিশ বক্স ভেঙে দেয় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন।
এসময় উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, "ট্রাফিক পুলিশ বক্সের জন্য জায়গা লাগবে, তবে সেটা আলোচনার ভিত্তিতে করতে হবে। দরকার হলে আমরা সরকারকে বলব পুলিশ বক্সের জন্য জায়গা দিতে। কিন্তু এভাবে পুরো ফুটপাত দখল করে পুলিশ বক্স করা হবে, তা কাম্য নয়।"
তবে এ বিষয়টিকে সমন্বয়হীন কাজ উল্লেখ করে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "যেকোনো কাজে তো একটি সমন্বয় দরকার আছে। এখানে যদি নোটিশের বিষয় থাকতো কিংবা আমাদের জানানো হতো তাহলে জিনিসটা আরও সুন্দরভাবে করা যেতো।"
ট্রাফিক পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্যের সাথে কথা বললে তারা জানান, সারাদিনের কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে একটু বিশ্রাম খুবই জরুরি। এছাড়া ওয়াশরুম, ঝড়-বৃষ্টি বা তীব্র গরমে ক্ষণিকের আশ্রয়ের জন্য পুলিশ বক্স জরুরি।
তারা বলছেন, সিটি করপোরেশনের অনুমোদন নিয়ে কিছু জায়গায় পুলিশ বক্স করা হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে লিখিত কিছু না দিয়ে শুধু মৌখিক সম্মতির ভিত্তিতে এসব পুলিশ বক্স করা হয়েছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "আমরা অনেক সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করি। আমাদের যারা মাঠে দায়িত্ব পালন করেন তাদের মাঝে মাঝে একটু বিরতির দরকার আছে। তার ভিত্তিতেই পুলিশ বক্সের এ বিষয়গুলো অনেক আগ থেকেই হয়ে আসছে।"
ডিএমপির এ কর্মকর্তা বলেন, এ বক্সগুলো বাস্তবতার ভিত্তিতেই করা হয়েছিল। প্রয়োজন আছে বলেই এগুলো করা হয়েছে।
যেসব বক্স ফুটপাতের উপর রয়েছে এগুলোর ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "বিশ্বের এমন কোনো দেশের শহর পাওয়া যাবে না যাদের ট্রাফিক পুলিশ বক্স ফুটপাতের উপর না। সবকিছুর কথা বিবেচনা করেই ফুটপাতে স্থাপন করা হয়। আমরা দুই সিটি কর্পোরেশনের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। দক্ষিণ সিটি থেকে আমাদের কিছু জায়গা দিলেও উত্তর থেকে সেমন সাড়া পাইনি।"
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা টিবিএসকে বলেন, "ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের সাথে আমাদের নিয়মিতই আলোচনা হচ্ছে। তবে ফুটপাতে পথচারীদের সমস্যা সৃষ্টি করে পুলিশ বক্স নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হবে না। এজন্য ঐসব এলাকায় খালি জায়গা খুঁজতে হবে। যদি খালি জায়গা খুঁজে পাওয়া না যায় তবে সরকার জমি কিনে তাদের ব্যবস্থা করে দিবে।"
ডিএমপি তাদের কাছে কয়েকটি স্থানে পুলিশ বক্স নির্মাণের জন্য আবেদন করেছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের টিবিএসকে বলেন, "ফুটপাত কিংবা রাস্তার উপর কেউই কোনো স্থাপনা করতে পারবে না। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন গত দুই বছরে বেশ কয়েকটি পুলিশ বক্স ভেঙ্গে দিয়েছে ফুটপাত ও রাস্তার উপর তৈরি করার কারণে এবং এ কার্যক্রম অব্যাহত আছে।"
তিনি বলেন, দক্ষিণ সিটির কিছু কিছু স্থানে ডিএমপি সমন্বয় করে পুলিশ বক্স তৈরি করেছেন। সিটি করপোরেশন ও ডিএমপির সাথে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। তবে অযাচিতভাবে যেন কোনো স্থানে পুলিশ বক্স তৈরি করা না হয় সে বিষয়ে দক্ষিণের মেয়রের নির্দেশনাও দেওয়া আছে তাদের।