চট্টগ্রামে গার্ডার ধসে ১৩ নিহতের ঘটনায় বিচার শেষ হয়নি সাড়ে ৯ বছরেও
২০১২ সালে চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ১৩ জনের মৃত্যুর ঘটনার পর সাড়ে নয় বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও শেষ হয়নি বিচার কার্যক্রম।
২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে অভিযোগ গঠন করার ৮ বছর পার হলেও রাষ্ট্রপক্ষ সকল সাক্ষীকে হাজির করতে পারেনি।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, ঘটনার সময় উপস্থিত যেসব মানুষদের সাক্ষী করা হয়েছে, ঘটনার ৯ বছর পরে অনেকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তারা অনেকে ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেরায় সাক্ষী নেওয়া যাচ্ছে না বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অনুপম চক্রবর্তী।
চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর অনুপম চক্রবর্তী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সাক্ষীদের মধ্যে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা, দুজন চিকিৎসক এবং স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ ২৭ জন ছিলেন। এরমধ্যে ১৯ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। বাকিদের উপস্থিত হতে সমন জারি করা হয়েছে। বাকী থাকা সাক্ষীদের বেশিরভাগ অস্থায়ী হওয়ায় অন্যত্রে চলে গেছে।"
"এছাড়া একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীণ সহকারী রেজিস্ট্রার পুলক কুমার বিশ্বাসের সাক্ষ্য গ্রহণ বাকি। তিনি ঢাকায় আছেন বলে জেনেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করছি। আশা করছি, পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ১০ অক্টোবর তাকে হাজির করা যাবে।"
এ ঘটনায় কর্তব্যে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে মামলা করেন চান্দগাঁও থানার তৎকালীন এসআই আবুল কালাম আজাদ। মামলায় ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান, সহকারী প্রকৌশলী তানজিব হোসেন ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী সালাহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আখতার অ্যান্ড পারিসা ট্রেড সিস্টেমসের ১০ জন এবং বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএআরএম অ্যাসোসিয়েটসের ১২ জনসহ ২৫ জনকে আসামি করা হয়।
এছাড়া ওই বছরের ২৯ নভেম্বর তৎকালীন সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, প্রকল্প পরিচালক এ এমএম হাবিবুর রহমান, প্রধান প্রকৌশলী নাছির উদ্দিন মাহমুদ, প্রয়াত আওয়ামীলীগ নেতা জাহাঙ্গির সাত্তার টিংকুর স্ত্রী ও মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটকো-পারিশা কনস্ট্রাকশন্সের স্বত্তাধিকারী খুজেস্তা ই নূর ই নাহরিন মুন্নী, নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান মির আক্তার-পারিশা(জেবি) কনস্ট্রাকশন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এ এ আর এম অ্যাসোসিয়েটস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ মতিনকে আসামি করে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম নুরে আলম ভূঁইয়ার আদালতে নাগরিক অধিকার ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠনের মহাসচিব লায়ন এ্যাডভোকেট যাদব চন্দ্র শীল বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
তবে আদালতের নির্দেশে পুলিশের দায়েরকৃত মামলার সঙ্গে এটি মার্জ করা হয়।
পুলিশের দায়েরকৃত মামলাটির তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর আট জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক এসএম শহীদুল ইসলাম। আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে সিডিএর তিন কর্মকর্তা, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ তিন জন এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মতিনসহ ১৮ জনের নাম বাদ দেওয়া হয়।
সর্বশেষ অভিযোগপতত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আখতারের সে সময়ের প্রকল্প ব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দিন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মনজুরুল ইসলাম, প্রকল্প প্রকৌশলী আব্দুল জলিল, আমিনুর রহমান, আব্দুল হাই, মো. মোশাররফ হোসেন রিয়াজ, মান নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলী শাহজান আলী ও রফিকুল ইসলাম নাম এজাহারভুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে রফিকুল ইসলামের নাম মামলার এজাহারে ছিল না। তদন্ত শেষে পুলিশ তার নাম অভিযোগপত্রে যুক্ত করেন।
২০১৪ সালের ১৮ জুন তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ এস এম মজিবুর রহমান অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আট আসামির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দেন। ২০২০ সাল থেকে মামলাটি চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঁঞার আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।
মামলাটি অবহেলাজনিত হত্যা মামলা হিসেবে বিবেচনা করে বিচার কাজ চলছে।
অনুপম চক্রবর্তী জানান, বাকি থাকা একজন চিকিৎসকের সাক্ষ্য পেলে মামলাটি প্রমাণ করা যাবে। ২০ জন সাক্ষী যথেষ্ট, তিনটি ধারায় মামলাটি চলছে।
"ধারা অনুযায়ী, আসামিদের সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। মামলার কার্যক্রম গুছিয়ে আনা হয়েছে। আশা করছি, চলতি বছরের শেষ দিকে মামলাটির ফলাফল আসবে।"
২০১০ সালের জানুয়ারিতে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১১ সালের মার্চে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ শুরু হয়। এর নির্মাণ কাজ চলাকালে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ধসের ঘটনায় ১৩ জন নিহত হন। এরপর মূল ফ্লাইওভারটির নির্মাণকাজ তদারকির দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
২০১৩ সালে মূল ফ্লাইওভারের উদ্বোধন করা হয়। ১ হাজার ৩৩২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৪ মিটার প্রস্থ ফ্লাইওভারটি করতে ব্যয় হয় প্রায় ১২০ কোটি টাকা।