লোডশেডিংয়ে নাকাল যশোরের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাত
গত কয়েক দিন ধরে চলছে টানা লোডশেডিং। প্রচন্ড গরমে মানুষের নাকাল অবস্থা। আর এ কারণে যশোরের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ৩০০ কারখানায় সক্ষমতার মাত্র একভাগ উৎপাদন করতে পারছেন উদ্যোক্তারা। পণ্য সংকটে ঠিকমত অর্ডার নিতে পারছেনা তারা। আবার বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি মেটাতে নিজস্ব ব্যবস্থায় চলছে অনেক কারখানা। এই বিদ্যুৎ উপাদন করতে গিয়ে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে কারখানাগুলোর। এতে একদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে কমছে উৎপাদন।
দেশব্যাপী রুটিন লোডশেডিংয়ে বিপাকে পড়েছে গোটা উৎপাদন খাত। কারখানাগুলোতে সার্বক্ষণিক উৎপাদন চালু রাখার ফার্নেস অয়েল দিয়ে জেনারেটর বা নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে ব্যয় ৩০ শতাংশ বাড়ছে বিভিন্ন শিল্প খাতে। রুটিন লোডশেডিংয়ের মধ্যে ফার্নেস অয়েল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ব্যয় বহন করার সক্ষমতা না থাকায় ১৯ জুলাই দেশব্যাপী বিদ্যুৎ রেশনিং কার্যকর হওয়ার পর অনেক কারখানাই বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে।
শিল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগে থেকেই করোনার কারণে বাজার মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে ছিলেন তারা। এর মধ্যে চলমান বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকট তাদের আর্থিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
বিগত পাঁচ দশকে গাড়ি শিল্প বলতে সবই আমদানি নির্ভর ছিল। ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে গাড়ির বডি (চ্যাসিস) আসত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। কিন্তু সেই অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। যশোরেই প্রস্তুত করা হচ্ছে গাড়ির যন্ত্রাংশ ও বডি। এতে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে, তেমনি দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে।
তবে যশোরের অটোমোবাইলস শিল্পের সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। প্রযুুক্তিগত মেশিনারির ব্যবহার ছাড়াই আগেকার দিনের হাতুড়ি-ছেনি ও ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতির সাহায্যে শ্রমিকরা এসব কাজ করে থাকেন। অর্ধশিক্ষিত শ্রমিকদের মেধা আর মননশীলতার মাধ্যমে টিন, কাঠ আর হরেক রকমের নাট-বল্টু ব্যবহার করে বিভিন্ন নামীদামি বিদেশি ব্র্যান্ডের গাড়ির বডি তৈরি করে দেশজুড়ে সুখ্যাতি কুড়িয়েছে যশোরের ওয়ার্কশপগুলো।
একদিকে কর্মদক্ষতা অন্যদিকে অল্প মুনাফায় ভালো সেবা দেওয়ার কারণে সারা দেশের বাস-ট্রাক মালিকরা নতুন ও পুরাতন গাড়ির বডি ও পার্টস তৈরি করতে আসেন যশোরের ওয়ার্কশপে। এদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত পরিবহন মালিকরাও রয়েছেন।
তবে করোনার ছোবলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এ খাতের মালিক-শ্রমিকরা। এখনও তাদের ব্যবসায় মন্দাভাব কাটেনি। সেই অবস্থা না কাটতেই নতুন করে যোগ হয়েছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। চাহিদা থাকলেও পণ্য উৎপাদন করতে পারছেন না তারা।
যশোর শহরের বকচর, হুশতলা-মুড়লী মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় আট শতাধিক অটোমোবাইলস ওয়ার্কশপ রয়েছে। এসব ওয়ার্কশপে পাঁচ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করছে। ওয়ার্কশপগুলোতে নতুন বাস-ট্রাকের বডি তৈরি, পুরাতন বডি সংস্কার, রং, ওয়ারিং ও ইঞ্জিন মেরামত কাজ করে প্রতিমাসে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা আয় হয়।
যশোর শহরের বকচরের আল-একলাস হোল্ডিং ওয়ার্কশপের মালিক নুরুজ্জামান শেখ বলেন, 'যশোরের ওয়ার্কশপগুলোতে কোরিয়ান, জাপানি, ইন্ডিয়ান গাড়ির বডির আদলে বাস ট্রাকের বডি ও ক্যাবিন বানানো হয়ে থাকে। পুরনো জরাজীর্ণ গাড়ির চ্যাসিসে নতুন করে সংযোজন করা বডি কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত টেকসই হয়। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে শ্রমিকরা কাজ করতে পারছেনা।'
যশোর অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি আশরাফুল আলম বলেন, 'দেশের অন্য যে কোনো জায়গার তুলনায় খরচ কম হওয়ায় এবং কাজের মান ভালো হওয়ায় খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, পাবনা, মাগুরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নাটোর, রংপুর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার গাড়ি মালিকরা বডি তৈরি ও গাড়ির পার্টস কিনতে যশোরে আসেন। বর্তমানে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তেমন ব্যবসা নেই। আবার বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছেনা। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছি আমরা।'
ঈগল পরিবহনের স্বত্বাধিকারী পবিত্র কাপুড়িয়া জানান, 'যশোরের শ্রমিকরা তৈরি করছে গাড়ির পার্টস ও বডি। যা মানসম্মত। আমাদেরও অনেক গাড়ির বডি, পার্টস এখান থেকে নিয়ে থাকি।'
যশোরে শতাধিক গাড়ির পার্টস, স্প্রিংপাতি ও বডি উৎপাদন হচ্ছে। যা আগে সবই আমদানি নির্ভর ছিল। এসব উৎপাদিত গাড়ির পার্টস ব্যবহার করছেন দেশের প্রতিষ্ঠিত পরিবহন ও স্থানীয় রুটের গাড়ির ব্যবসায়ীরা। একই সাথে পাথর ও ইটভাঙ্গা মেশিনও তৈরি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে পাথরভাঙ্গা মেশিন ভারতে রপ্তানি করছেন উদ্যোক্তারা। যার বাজার হাজার কোটি টাকা বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
যশোরের গাড়ির পার্টস উৎপাদনকারীদের মধ্যে অন্যতম এনায়েত ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মোঃ আক্তার হোসেন জানান, 'বিসিক শিল্পনগরীতে ২০১১ সালে আমরা এক বিঘা জমির উপর কারখানা গড়ে তুলি। আমাদের কারখানায় ৫০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। আমাদের কারখানায় শতাধিক গাড়ির পার্টস উৎপাদন করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে গাড়ির ব্রেকড্রাম, পেসারপ্লেট, গিয়ারবক্স, ব্রেকডিস্ক, ইঞ্জিন হাউজিং, হ্যাঙ্গার, গিয়ার বক্সের বডি। এসব পার্টস সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। স্বনামধন্য পরিবহন ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে স্থানীয় রুটের গাড়ির মালিকরা এসব পার্টস ব্যবহার করছেন।'
তিনি বলেন, 'বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন অর্ধেকের নীচে নেমে গেছে। সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত শ্রমিকরা আগে পাঁচ টন মাল গলাত। কিন্তু এখন সেটি এক থেকে দুই টন হচ্ছে। বিদ্যুৎ থাকছেনা ৪-৫ ঘণ্টা। লোহা বা পাত গলানোর মধ্যে যদি বিদ্যুৎ চলে যায় সেটি আবারও গলাতে হয়। এভাবে আর পারছিনা। ব্যয় বাড়লেও উৎপাদন কম হচ্ছে।'
শহরতলীর উপশহর এলাকায় এসকে মেটাল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলেন তরুণ উদ্যোক্তা কামরুল হাসান সোহেল। বর্তমানে সেখানে পিকআপের স্প্রিংপাতি উৎপাদন হচ্ছে। এস পিকআপ, টিকিং পিকআপ, জেক ও আইশার পিকআপে ব্যবহার হচ্ছে এই স্প্রিংপাতি। প্রতিমাসে গড়ে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার পিস স্প্রিংপাতি উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি।
কামরুল হাসান সোহেল জানান, 'নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা পেলে স্প্রিংপাতির বাজার আরও বড় করতে পারতাম। কিন্তু এখন চলছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। যে কারণে পণ্য উৎপাদন করতে পারছিনা।'
যশোরের রিপন মেশিনারিজের স্বত্বাধিকারী আশরাফুল ইসলাম বাবু জানান, বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন হচ্ছে স্টোন মিনি ক্রাশার, ইটভাঙ্গা, পাথরভাঙ্গা মেশিন, ইস্পলার, প্রেসার পুলি, লাইনার স্লট প্লেট, পানির পাম্প, শ্যালো ইঞ্জিনের মেশিনসহ বিভিন্ন ধরণের মেশিনারিজ। ওই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পাথরভাঙ্গা মেশিন দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে মাসে তাদের উৎপাদিত ২৫টি পাথরভাঙ্গা মেশিন ভারতে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। যার প্রতি মেশিনের দাম সাড়ে ৪ লাখ টাকা। সারা দেশের বাজারে তাদের ইট ও পাথরভাঙ্গা মেশিনের চাহিদা ভালো। অথচ টানা লোডশেডিংয়ের কারণে সেটি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি যশোর জেলা শাখার সদস্য সিরাজ খান মিন্টু জানান, 'জেলায় ৩০০টি হালকা ও ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি প্রতিষ্ঠান ভারি শিল্প পণ্য উৎপাদন করছে। যার মধ্যে রয়েছে বড় গাড়ির পার্টস, পাথর, খোয়াভাঙ্গা মেশিন, কৃষি পার্টস মেশিনারিজ, পাওয়ার টিলার মেশিন, রাইস মিলের মেশিন, বড় গাড়ির যন্ত্রাংশ উল্লেখযোগ্য। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে বছরে হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। অথচ বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে সেটি ব্যাহত হচ্ছে। কেউ ঠিকমতো পণ্য উৎপাদন করতে পারছেনা।'
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, 'আগে গাড়ির সব ধরণের যন্ত্রাংশ আসত আমদানি হয়ে। সেখানে আমাদের দেশও এখন কিছু যন্ত্রাংশ উৎপাদন করছে। বিশেষ করে যশোরের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প প্রতিষ্ঠান অনেক আগে থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত যন্ত্রাংশ ভালোমানের। তবে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে যদি উৎপাদন কমে যায় তাহলে সেটি ভালো খবর নয়, এজন্য সরকারকে শিল্পখাতে বিদ্যুতের লোডশেডিং করা থেকে বিরত থাকতে হবে।'
সরকারের কাছে শিল্প খাতকে চলমান বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আওতার বাইরে রাখার দাবি জানান তিনি।