ক্রিপ্টো: অর্থ পাচার নয়, লেনদেনকারীর ওয়ালেট খোঁজে পুলিশ
বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ পাচারের সম্ভাবনা থাকলেও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এবং দক্ষতার অভাবের কারণে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত শুরু করতে পারেনি।
অর্থপাচার ও অবৈধ অর্থায়নের নতুন মাধ্যম হিসেবে কিপ্টোকারেন্সিকে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী ও সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থাগুলো।
গত প্রায় ৫ বছরে অন্তত ১৫ টি অভিযান পরিচালনা করে অন্তত ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট।
গ্রেপ্তারের পর দীর্ঘ সময় নিয়ে শুধু ভার্চুয়াল ওয়ালেট শনাক্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে তদন্ত শেষ করছে তারা।
ব্লকচেইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য সুরক্ষিত থাকে। তথ্য সংরক্ষণ করার অন্যতম নিরাপদ এবং উন্মুক্ত পদ্ধতি হলো ব্লকচেইন। বিভিন্ন 'ব্লকে' একটির পর একটি চেইন আকারে তথ্য সংরক্ষণ করা হয় ব্লকচেইনে। এই ডিজিটাল লেনদেন অপরিবর্তনযোগ্য, যা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্যই প্রযোজ্য নয়।
দুইজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নিজের পরিচয় প্রকাশ করে সরাসরি ভার্চুয়াল মুদ্রা লেনদেন করতে পারে। একটি ২৭-৩৪ ডিজিটের ইন্টারনেট অ্যাকাউন্ট এবং আইডি খোলার মাধ্যমে মুদ্রা লেনদেন করতে হয়।
এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার ২৭ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইউনিটে মামলার তদন্ত চলছে। তবে অধিকাংশ মামলার তদন্তই ফরেনসিক প্রতিবেদন না পেয়ে আটকে আছে। ফলে এখন পর্যন্ত ৯ মামলার মাত্র ৪ টিতে চার্জশিট দেয়া হয়েছে।
গত বছরের মে মাসে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকা থেকে ১২ জনকে আটক করে র্যাব। এ সময় ২৯টি কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, নথিপত্রসহ অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। তখন র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্রেফতারকৃত সুমন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করার পর অনলাইন মার্কেটিংয়ের কাজ শুরু করেন। শুরুতে একটা ছোট অফিস থাকলেও পরে বাড্ডায় একটি ভবনের তিনটি ফ্লোরে ৩২ জন কর্মচারী নিয়ে বিটকয়েনের ব্যবসা করে। বিটকয়েনের ব্যবসা করে ঢাকায় দু'টি ফ্ল্যাট, প্লট, সুপার শপের মালিক হওয়ার তথ্যও দিয়েছে ইসমাইল।
র্যাব আরও জানায়, এই গ্রুপটি ছিলো দেশের সবচেয়ে বড় বিটকয়েনের লেনদেনকারী গ্রুপ। তদন্তে তাদের লেনদেনের বিস্তারিত বেরিয়ে আসবে। এরপর বাড্ডা থানায় করা র্যাবের এই্ মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। এর এক বছর পেরিয়ে গেলেও তদন্ত শেষ করতে পারেনি তারা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা টিবিএসকে জানিয়েছেন, এই মামলায় তদন্তের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ কাজ ফরেনসিক রিপোর্ট। তবে তাদের ডিভাইসগুলো সংশ্লিষ্ট ইউনিটে পাঠানোর পর এখনো তারা ফরেনসিক রিপোর্ট দিতে পারেনি। ফলে তদন্তের পরবর্তী কাজ এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি।
বগুড়া জেলা সাইবার পুলিশের একটি টিম ২০১৯ সালে ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন তথ্য পেয়ে দুজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে এ মামলার তদন্ত শেষ করা হয় কিপ্টোকারেন্সির লেনদেনের ভার্চুয়াল ওয়ালেট শনাক্ত করেই।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে বিটকয়েন লেনদেন করে আসছিল। তদন্তে প্রাথমিকভাবে এক কোটির বেশি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে এবং সে তথ্যের ভিত্তিতেই চার্জশিট দেয়া হয়েছে। তবে তাদের মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করলে তাদের মাধ্যমে আরও কেউ লেনদেন করেছে কিনা বা আরও কোন গ্রুপ যুক্ত আছে কিনা তা জানা যেতো।
এদিকে র্যাব বিট কয়েনের সবচেয়ে বড় গ্রুপকে আটকের পর তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার আইনে অনুসন্ধান শুরু করে সিআইডি। তবে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে সে অনুসন্ধান। তিনবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হলেও তারা এখনো কোন লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনা করতে পারেনি তারা।
এর আগে গাজীপুর থেকেগ্রেপ্তার করা হয় রায়হান হোসেন নামে এক যুবককে। তখন র্যাব জানিয়েছিলো বিটকয়েন লেনদেন করে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যাক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ রায়হান। তার মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন হওয়ার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তার বিরুদ্ধে অর্থপাচার আইনে শুরু হওয়া অনুসন্ধান এখনো শেষ করতে পারেনি সিআইডি।
জানতে চাইলে পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, বিটকয়েনের মতো প্রযুক্তির নতুন এই বিষয়ে আমাদের দক্ষতা নেই ফলে যথাযথ তদন্ত হচ্ছে না। আমাদেরকে প্রশিক্ষণ ও তদন্তের প্রয়োজনীয় ডিভাইস না দেওয়ায় এখন পর্যন্ত এসব মামলার তদন্ত কিংবা অনুসন্ধান গতি পাবে না।
প্রশিক্ষণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি
একটি গোয়েন্দা সংস্থার কিপ্টোকারেন্সি সংক্রন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিঠি পাঠায় পুলিশ সদর দপ্তরে। চলিত বছরের শুরুতে পাঠানো ওই চিঠিতে পুলিশের সাইবার ইউনিট এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার সংগ্রহের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এতে বিটকয়েনের ব্যবহারকারী ও ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনতে নির্দেশনার পাশাপাশি বিটকয়েনের প্রযুক্তি সম্পর্কিত আধুনিক তথ্য ও জ্ঞানলাভে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে বলা হয়।
তখন পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছিল, ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ইন্টারপোল ও এফবিআইয়ের সঙ্গে সিআইডির কর্মকর্তারা একাধিক বৈঠক করেছে। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তারা প্রাথমিক কিছু প্রশিক্ষণ দেবে। তবে নজরদারির সরঞ্জামাদির দাম অনেক বেশি হওয়ায় এখনই তা কেনা হবে না। এ ছাড়া ডার্কওয়েব ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশকে তিন বছরের প্রশিক্ষণ দেবে। চলতি বছর থেকেই এই প্রশিক্ষণ শুরু হবে।
অর্থ পাচারসহ ৬ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ওই নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোন কার্যক্রম শুরু করেনি পুলিশ সদর দপ্তর।
বিশেষজ্ঞরা সাথে তদন্ত করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক ড. বিএম মইনুল হোসেন টিবিএসকে বলেন, পুলিশের উচিত বিটকয়েনের মতো মাধ্যম ব্যবহার করে অবৈধ লেনদেন প্রতিরোধে আলাদা টিম গঠন করা। যারা এসব বিষয়ে দক্ষ থাকবে।
"অথবা অর্থপাচারে অনুসন্ধান যারা করছেন তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় ডিভাইসের সাপোর্ট দেওয়া।"
বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা শুধু ওয়ালেট শনাক্ত করেই তদন্ত শেষ করছে। যদি তারা নিজেরা দক্ষ হয়ে উঠতে না পারে তাহলে এটা বলে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।
"যারা এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ তাদের সহযোগীতা নিয়ে তদন্তের কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিৎ।"
৫ বছরেও কোন সিদ্ধান্তে আসেনি
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৭ সালে বিটকয়েনের মতো কৃত্রিম মুদ্রায় লেনদেন থেকে বিরত থাকার বিষয়ে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল। বিজ্ঞপ্তিতে ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক বলে ভার্চ্যুয়াল মুদ্রায় লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সম্পর্কিত আইনের লঙ্ঘন হতে পারে।
তবে এর মধ্যেই ক্রিপ্টোকারেন্সিকে একেবারে নাকচ করে না দেওয়ার ব্যাপারে কথাবার্তা চলে সংস্থাগুলোর মধ্যে। যেমন, সরকারের ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি ডিভিশন। ২০২০ সালের মার্চে এ বিভাগ ন্যাশনাল ব্লকচেইন স্ট্র্যাটেজি করে। ওই কৌশলপত্রে তারা বলেছে, ব্লকচেইন স্টার্টআপে ২০১৩ সাল থেকে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে।
এই বিনিয়োগ ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশি সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিগুলোর জন্য এটা একটা সুযোগ। কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকায় বাংলাদেশের সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি এ আকর্ষণীয় সুযোগের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
অবশ্য ওই কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, উপযুক্ত প্রযুক্তি, আইন ও নীতি কাঠামোর অনুপস্থিতিতে এ ধরনের ডোমেইন দেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের পথকে উন্মুক্ত করে দিতে পারে। তাই এই উভয়সংকট কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, তা বিবেচনা করা উচিত।
এছাড়াও গত বছর একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে কিপ্টোকারেন্সি নিয়ে সিআইডি মতামত চেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ক্রিপ্টোকারেন্সির মালিকানা, সংরক্ষণ বা লেনদেন স্বীকৃত না হলেও এটিকে অপরাধ বলার সুযোগ নেই মর্মে প্রতীয়মান হয়।
ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেনের ফলাফল হিসেবে দ্বিতীয় পর্যায়ে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭ সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর আওতায় অপরাধ হতে পারে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সিআইডি এ নিয়ে অনুসন্ধান করে দেখতে পারে।