ভয়ার্ত পরিবেশের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে: মানবাধিকার কর্মীরা
দেশে এখন এক ভয়ার্ত পরিবেশের মধ্য দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
তারা বলছেন, আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে এ নিয়ে কাজ করতে ভয় ছিল না কিন্তু এখন কাউকে তুলে নিয়ে গেলে সে বিষয়ে কাজ করার সাহস তারা পাচ্ছেন না। গুম, খুনের এ পরিবেশে সমাজকে একটা ভয়ের চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে।
শনিবার রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অডিটরিয়ামে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) আয়োজিত মানবাধিকার সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সংগঠনটির ৮ম মানবাধিকার সম্মেলনে এবারের প্রতিপাদ্য ছিল 'গুম-খুন-নির্যাতনে আর চুপ নয়, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরে ভয়কে করব জয়'।
সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি, মুনিয়ার মৃত্যু হত্যা নাকি আত্মহত্যা, নাকি প্ররোচিত হত্যা—এটা নিয়ে নানা কারণে আমরা খুব একটা কথা বললাম না। আজকে মুনিয়া, কাল তো আমিও হতে পারি। পরশু তো আরেকজন হতে পারে। যখন অধিকারের বিষয়টা সর্বজনীন দায়িত্বে পরিণত হয়, তখন অধিকার আদায় করা সহজ হয়।'
সংবিধান অনুযায়ী জনগণ সব ক্ষমতার উৎস হলেও এ চর্চা হচ্ছে না উল্লেখ করে রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'এটা চর্চা না করতে করতে এমন অবস্থা করেছি যে ওরা যা ইচ্ছা তা করে ফেলতে পারে। বইয়ের ভাষা দিয়ে সব সময় আন্দোলন হয় না। তাই মানবাধিকারকর্মীদের মাঠে নামতে হবে।'
এক প্রশ্নের জবাবে রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'সুশীল সমাজ কথা বলতে বলতে "আয়নাঘর" উন্মোচিত হয়েছে। সুশীল সমাজের যেভাবে বলার কথা ছিল, অনেক জায়গায় আমরাও ব্যর্থ হয়েছি, অনেক জায়গায় সিস্টেম আমাদের ব্যর্থ করেছে। কিন্তু আমাদের বলতে হবে।'
মানবাধিকার আন্দোলন করতে গিয়ে জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের কথা সম্মেলনে তুলে ধরেন মানবাধিকারকর্মী ড. হামিদা হুসাইন।
তিনি বলেন, মানবাধিকার আন্দোলনে সকল ধরনের বৈচিত্রকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং সংঘবদ্ধভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো মোকাবিলা করতে হবে।
সংগঠনটির প্রধান উপদেষ্টা মানবাধিকারকর্মী নুর খান বলেন, 'আয়নাঘর নিয়ে যে কথাগুলো বলা হচ্ছে, গুম অবস্থা থেকে যারা ফিরে এসেছেন, তাদের অনেকে একই কথা বলেছেন। অনেকে আবার এখন পর্যন্ত কথাই বলেননি।'
তিনি বলেন, 'এই বিষয়গুলো নিয়ে মানবাধিকারকর্মী বা সুশীল সমাজের একটি অংশের যেভাবে সোচ্চার হওয়ার কথা ছিল, তারা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কারণে এ নিয়ে কথা বলছেন না। আগে যেখান থেকে প্রতিবাদ হতো—সাংস্কৃতিক কর্মী বা শিক্ষক, সেই জায়গা থেকে সেভাবে প্রতিবাদ হচ্ছে না।'
একসময় এ ধরনের নির্যাতনের ব্যাপারে কথা বলতে পেরেছেন উল্লেখ করে নুর খান বলেন, 'তখন তারা নির্যাতনের বিষয়ে পরিবার, থানা, কোর্টকাছারিতে দৌড়াতে পেরেছেন। তখন এতটা ভয় ছিল না।'
এ মানবধিকার কর্মী বলেন, 'গণতন্ত্র ও মানবাধিকার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি ছাড়া অন্যটি সম্ভব নয়। তাই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে সর্বপ্রথম। আজ বাংলাদেশে মানুষকে নানাভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এখন স্বাধীন দেশে বাকস্বাধীনতার খুবই অভাব।'
ভয়কে জয় করেই যুবসমাজকে এগিয়ে যেতে হবে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী নুর খান। তিনি বলেন, 'ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য, মানবিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য ও রাজনীতিতে নৈতিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য ভয়কে জয় করেই এগিয়ে যেতে হবে।'
আইনের চোখে যাদের শিশু মনে করা হয়, তাদের বিরুদ্ধেও এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হচ্ছে বলে সম্মেলনে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক সারা হোসাইন।
তিনি বলেন, 'শিশু আইনে গুরুতর কোনো অপরাধ না হলে তাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কোনোভাবেই একটি বক্তব্যকে গুরুতর বলা যায় না, এরপরও প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত, বিচার হওয়ার আগপর্যন্ত, মাসের পর মাস আটক করে রাখার ঘটনা ঘটছে।'
সংগঠনের চেয়ারম্যান শাহজাদা আল আমিনের সভাপতিত্বে সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম, গবেষণা ও প্রকাশনা কর্মকর্তা ইমামুল হোসাইন প্রমুখ।