অবশেষে অধিভুক্ত ৭ কলেজের সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা ঢাবির
বছরের পর বছর ধরে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগের পর অবশেষে অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কর্তৃপক্ষ বলছে, এ উদ্যোগের মাধ্যমে অধিভুক্ত সাত কলেজের দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো সমাধান করা হবে এবং কর্মমুখী শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কর্তৃপক্ষের বলছে, এ পরিকল্পনার অধীনে অধিভুক্ত সাত কলেজের পুরনো ল্যাবরেটরিগুলোর আধুনিকায়ন করা হবে, নতুন নতুন বিভাগ ও ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা হবে, শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং চাকরির বাজারে যেসব কোর্সের চাহিদা কম সেগুলো কমিয়ে আনা হবে।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই এ পরিকল্পনার একটি প্রস্তাব তৈরি করেছে। আগামী মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে এ প্রস্তাব পাঠানো হবে। প্রাথমিকভাবে, কলেজগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য ঢাবির ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. এএসএম মাকসুদ কামাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ঢাবির অধিভুক্ত কলেজগুলো নানাবিধ সমস্যায় ভুগছে এবং বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করা কঠিন।
তিনি আরও বলেন, "এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে এবং সবকিছু নতুনভাবে শুরু করতে আমরা একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। কিছু যাচাই-বাছাই ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সাথে বৈঠকের পর সেপ্টেম্বরে এটি চূড়ান্ত করা হবে।"
এ পরিকল্পনা অনুযায়ী, দক্ষ জনশক্তি তৈরির উদ্দেশ্যে কলেজগুলোতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই), ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই),তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট (আআইটি) এবং ডিপ্লোমা কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এর পাশাপাশি, চাকরির বাজারে চাহিদা কম এমন কিছু কোর্সের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে।
ব্যবহারিক ক্লাস নেওয়ার জন্য কলেজগুলোর পুরনো ল্যাবরেটরিগুলো সংস্কারের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা হবে। এ কাজে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছে ঢাবি। এছাড়াও, শিক্ষকরা যেন কলেজগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারেন, সেজন্য তাদেরকে প্রশিক্ষণও দেবে ঢাবি।
বর্তমানে ঢাবির অধিভুক্ত সাতটি কলেজে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৫৫, যেখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এই অনুপাত হওয়া উচিত ১: ১৫। কলেজগুলোতে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করবে ঢাবি।
অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, "অধিভুক্ত কলেজগুলোর প্রতিটি বিভাগে ২০০-৪০০ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে থাকে। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় এবং বসার সিটের অভাবে অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসেই যায় না। একই ক্লাসরুমে অনেক শিক্ষার্থী থাকলে তাদের পক্ষে মনোযোগ ধরে রাখাও কঠিন হয়ে ওঠে।"
তিনি আরও বলেন, "এমন অবস্থায় শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের দিকে ভালোভাবে নজর দিতে পারেন না। তাই মন্ত্রণালয়কে এই কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক দিতে হবে। আর শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ছেড়ে দিলেই ভালো হবে। আমরা পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচি তৈরি আর মূল্যায়ন করব। একাডেমিক চাহিদা অনুযায়ী আমরা যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারবো।"
কলেজগুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি উন্নয়ন ও 'আধুনিকায়নে'র উদ্দেশ্যে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে পাবলিক কলেজগুলো পরিচালিত হতো। সে সময় সাত কলেজও ঢাবির অধীনেই পরিচালিত হতো। ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ভেতরে থাকা সাতটি পাবলিক কলেজকে আবারও নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দেশের সব পাবলিক কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পুনঃঅধিভুক্তির গেজেটও প্রকাশ করা হয়েছিল তখন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি কাজী নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি বাংলা কলেজ এবং সরকারি তিতুমীর কলেজ। বর্তমানে এই কলেজগুলোতে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা আড়াই লাখ।
কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই এই পুনঃঅধিভুক্তির সিদ্ধান্তের ফলে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত জীবনে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। পুনঃঅধিভুক্তির পাঁচ মাস পরও তাদের পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণা করা হয়নি।
এরপর ২০১৭ সালের ২০ জুলাই পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণার দাবিতে রাজপথে নেমে আসে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায়ের জন্য রাজধানীর শাহবাগে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা।
এদিকে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ এবং লাঠিচার্জ করায় নিজের এক চোখ হারান সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান।
কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন-প্রতিবাদের পরেও সাত কলেজের এ সংকট নিরসন হয়নি। ২০১৭ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত সেশনজট কমানো, সময়মতো পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ, কলেজগুলোতে প্রশাসনিক ভবন তৈরি, একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ, সময়মতো পরীক্ষা নেওয়া, পরীক্ষার খাতার স্বচ্ছ মূল্যায়ন ও অন্যান্য দাবি নিয়ে বহুবার রাজপথে আন্দোলন করেছে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
ইতিবাচক পরিবর্তন
সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ঢাবির অধিভুক্ত কলেজগুলো। উদাহরণস্বরূপ- শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে তারা। কোনো শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ৭০ শতাংশের কম হলে তাকে জরিমানা করার নিয়ম করা হয়েছে। গাইডবইয়ের বদলে এখন শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই পড়ার দিকে মনোযোগী হয়েছে।
ড. মাকসুদ কামাল বলেন, "আগে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বছরে অল্প কিছুদিন ক্লাসে আসতো। গাইডে দেওয়া কিছু প্রশ্ন পড়ে পরীক্ষায় বসতো তারা। এমনকি শিক্ষকরা সঠিকভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতো না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ পরিস্থিতি পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, সাত কলেজের পাঠদান ও শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বলেন, "আমি আশা করছি, নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় আমাদের সাহায্য করবে।"