পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে কৌশল প্রস্তুত করছে সরকার
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি খসড়া গাইডলাইন থেকে জানা গেছে, বিদেশে পাচার করা অর্থ বা সম্পত্তি চিহ্নিত করার পর জব্দ বা বাজেয়াপ্ত করার কৌশল প্রণয়ন নিয়ে কাজ করছে সরকার।
পরবর্তী পদক্ষেপ হবে যেখানে অর্থ পাচার করা হয়েছে, সেই দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে তদন্ত করে অর্থ ফেরানোর উদ্যোগ নেয়া।
সম্পদ জব্দ করতে আদালতের আদেশ পেতে দেরি হলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে লেটার অব রোগেটরি পাঠিয়ে ওই দেশের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাচারকারীর অর্থ বা সম্পদ অন্য দেশে স্থানান্তর প্রক্রিয়া আটকে দেবে করবে সরকার। লেটার অব রোগেটরি হলো, বিচারিক সহায়তার জন্য এক দেশের আদালত থেকে অপর একটি দেশের আদালতের কাছে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ।
সরকার মনে করছে, এতে অর্থ পাচারকারী ব্যক্তি আর্থিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তার তদন্ত প্রভাবিত করার ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়বে, যা দ্রুত ও যথাযথ তদন্তে অত্যন্ত সহায়ক হবে।
বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে 'পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার: আইনী কাঠামো ও কৌশলগত প্রক্রিয়া' শিরোনামে প্রণীত খসড়া গাইডলাইনে এসব কৌশলের কথা উল্লেখ রয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ৭.৫ শতাংশ কর দিয়ে পাচারকারীরা অর্থ-সম্পদ দেশে ফেরত আনতে পারবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ সুবিধার আওতায় একজনও অর্থ ফেরত আনেনি।
বিদেশে পাচার করা সম্পদ জব্দ করে দেশে ফেরত আনতে সমন্বিত ও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার অংশ হিসেবে অর্থ পাচার প্রতিরোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশের ছয়টি সংস্থা—দুর্নীতি দমন কমিশন, বিএফআইইউ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিরেক্টরেট (সিআইআইডি) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এই খসড়া গাইডলাইন তৈরি করেছে।
অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য গঠিত ওয়ার্কিং কমিটি খসড়া গাইডলাইনটিকে সবুজ সংকেত দিয়েছে, যা অনুমোদনের জন্য ১১ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের সম্মতির পর খসড়া গাইডলাইনটি অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটির অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কী পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে, তার কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত (২০১৪ সালের বাদে) ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪৯.৬৫ বিলিইওন ডলার পাচার হয়েছে। প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৯৫ টাকা ধরলে স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ ৭১ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে উল্লিখিত সময়ে গড়ে প্রতি বছর পাচার হয়েছে প্রায় ৮৪ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৫ সালে পাচার হয়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি।
অর্থপাচারের অভিযোগে অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা হলেও স্বাধীনতার পর পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার নজির আছে মাত্র দুটি। এর একটি হলো, সিঙ্গাপুর থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর ২১ কোটি টাকা ফেরত আনা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ফিলিপাইনে পাচার হওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ফেরত এসেছে ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার এবং শ্রীলঙ্কা থেকে এসেছে ২০ মিলিয়ন ডলার।
কোকোর পাচার করা অর্থ যখন সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আনা হয়, তখন দুদকের চেয়ারম্যান ছিলেন গোলাম রহমান। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ওই সময় সিঙ্গাপুর সরকার ও আদালত বাংলাদেশকে অনেক সহায়তা করেছে।
বাংলাদেশ থেকে মূলত দুবাই, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং ও সিঙ্গাপুরে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'পাচার হওয়া এসব অর্থ ফেরত আনতে দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করা জরুরি।'
যোগাযোগ করা হলে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, 'দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নেই বলে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের রাখা অর্থের ব্যাপারে সুইজারল্যান্ড আমাদের কোনো তথ্য দেয় না।'
গোলাম রহমান বলেন, 'আন্তঃসংস্থা সমন্বয় নিশ্চিত করতে পারলে আমরা খসড়া কৌশল অনুসরণ করে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে পারব।
'কিন্তু ট্যাক্স হ্যাভেন হিসেবে পরিচিত আইল্যান্ড বা দেশগুলোতে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা কঠিন হবে। কারণ, ওইসব দেশ এক্ষেত্রে খুব একটা সহযোগিতা করবে না।'
এশিয়া-প্যাসিফিক গ্রুপ (এপিজে) অন মানি লন্ডারিংয়ের মূল্যায়নে বাংলাদেশের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হলেও বিদেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশের তেমন কোনো সফলতা নেই।
পাচার করা অর্থ উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ কয়েকটি দেশকে আইনগত সহায়তার জন্য অনেক অনুরোধ জানালেও দীর্ঘদিন যাবত জবাব না পাওয়ায় ওইসব মামলার বিচারিক প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করা যাচ্ছে না বলে খসড়া গাইডলাইনে উঠে এসেছে।
তবে দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০ ও ২০২১-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে আদালতের রায়ে দুবাইয়ে দুটি কোম্পানির শেয়ার ও মালয়েশিয়ায় পাঁচটি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছিল। আর ২০২১ সালে কানাডায় ২১টি ব্যাংক হিসাব, অস্ট্রেলিয়ায় ২৪টি ব্যাংক হিসাব ও সিঙ্গাপুরে পাঁচটি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করেছে দুদক।
বার্ষিক প্রতিবেদনে দুদক বলেছে, 'কমিশন শুধু দেশে নয়, বিদেশেও অবৈধ সম্পদ পাচারকারীদের তাড়া করছে। কেউ যেন অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে না পারে, সে বিষয়ে দুদক তার আইনী দায়িত্ব পালন করছে।'
অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই পাচার করা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করবে সরকার
পাচার করা অর্থ বা সম্পত্তি উদ্ধার প্রক্রিয়ায় প্রচলিত পদ্ধতি হলো প্রথমে আদালতে পাচারের অভিযোগ প্রমাণ করা, তারপর অপরাধলদ্ধ অর্থ বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু এ বিভিন্ন জটিলতার কারণে এ পদ্ধতিতে সফলতার হার খুবই কম। এছাড়া এ পদ্ধতিতে অত্যধিক পরিমাণ অর্থ, সময় ও শ্রম ব্যয় করতে হয়।
এসব বিবেচনায় বর্তমানে বিভিন্ন দেশ ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ করার আগেই অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থ বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ফেরত আনে, যা নন-কনভিকশন বেজড পদ্ধতি নামে পরিচিত। গাইডলাইনের খসড়া অনুযায়ী, পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে বাংলাদেশও এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে।
বিদেশে পাচার করা অর্থ বা সম্পদ ফেরত আনতে প্রতিটি কেসের আকার বা জটিলতা বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা বা দক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে যৌথ তদন্ত দল বা টাস্কফোর্স গঠন করবে বাংলাদেশ। কেসের ধরন ও স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় প্রয়োজনে বিদেশি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথ তদন্ত পরিচালনা করবে টাস্কফোর্স।
মামলার শুরুতেই সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সুসমন্বয়ের জন্য আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক দল বা টিম গঠন করাসহ তদন্তের সব পর্যায়ে আর্থিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করার কথাও গাইডলাইনে বলা হয়েছে।
খসড়া গাইডলাইনে বলা হয়েছে, যে দেশে অর্থ পাচার হয়েছে, সে দেশের সর্বোচ্চ সহযোগিতা না পেলে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাসেট রিকভারি, স্টার প্রটেকশন এজেন্সি ও ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমের সহযোগিতা নেবে সরকার।
এছাড়া সুইজারল্যান্ডসহ যেসব দেশ থেকে অনানুষ্ঠানিক তথ্য পাওয়ার সুযোগ সীমিত, সেসব দেশের ক্ষেত্রে পারস্পারিক আইনগত সহায়তার অনুরোধকে অগ্রাধিকার দেবে সরকার।
খসড়া গাইডলাইনে বলা হয়েছে, পাচার করা অর্থ উদ্ধারে বিদেশি সরকারের সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতার উপর বহুলাংশে নির্ভর করে।
যেসব ক্ষেত্রে পাচারকারী দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার কৌশল বাস্তবায়ন করা হবে, তার একটি তালিকা খসড়া গাইডলাইনে তুলে ধরা হয়েছে।
আসামি পলাতক হলে এবং তার বিরুদ্ধে ফৌজদারী অপরাধের অভিযোগ গঠন সম্ভব না হলে কিংবা দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তি মারা গেলে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে।
আবার অভিযুক্ত ব্যক্তি এতোই ক্ষমতাশালেী যে, তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ গঠন বাস্তবসম্মত নয়; যেখানে তৃতীয় পক্ষের কাছে সম্পদ রয়েছে এবং তিনি ওই সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিরুদ্ধে শুনানিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী নন এবং যেখানে ফৌজদারি আদালতে অপরাধ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য সংগ্রহ করা সম্ভব নয়—এসব ক্ষেত্রেও দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, 'আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে হলে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বিচারকাজ পরিচালনা করতে হবে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারকাজ সম্পন্ন করতে হবে। না হলে পাচারকারী তার সম্পদ অন্য দেশে সরিয়ে ফেলবে।'
তবে বিদেশে পাচার করা অর্থ বা সম্পদ ফেরত আনার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতার কথাও গাইডলাইনে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, বৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করলে বাংলাদেশের আইনে তা অপরাধ হলেও অনেক দেশের আইনে তা অপরাধ নয়।
তাছাড়া কোনো কোনো দেশ অর্থ বা সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার সময় তার অংশবিশেষ দুর্নীতি দমন বা অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করার শর্তারোপ করে থাকে।