ওজিএসবি হাসপাতাল: কম খরচে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা
হঠাৎ প্রসববেদনা ওঠায় গত ২৩ আগস্ট ৮ মাসের গর্ভবতী পুত্রবধু রুমানা আফরোজকে বিপদে পড়েন মিরপুর ১০ এর বাসিন্দা রুমা বেগম। কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন নরমাল ডেলিভারিতে প্রয়োজন হবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। পরে প্রতিবেশীর পরামর্শে রুমানাকে ভর্তি করান ওজিএসবি হাসপাতালে। একদিনের হাসপাতাল বিল, ডেলিভারি ও ওষুধে তার খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা।
তবে বিপদ পিছু ছাড়েনি, রুমা বেগমের পরিবারের। প্রিম্যাচিউর (নির্ধারিত সময়ের আগেই) হিসেবে জন্ম নেওয়ায় তার বাচ্চাকে নিউবর্ন ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট (এনআইসিইউ) তে রাখতে হয়েছে ৬ দিন। সেখানে বিল হয় ৪০ হাজার টাকা। চার হাজার টাকা ডিসকাউন্ট পেয়ে ৩৬ হাজার টাকা জমা দিয়ে নাতিকে নিয়ে রুমা বেগম বাড়ি ফেরেন সোমবার।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই হাসপাতালে খরচ কম হওয়ায় আমার নাতিটা বেঁচে গেলো। আমার দোকানদার ছেলের পক্ষে দিনে ১০-১৫ হাজার টাকা দিয়ে এনআইসিইউ তে নাতিকে রাখা সম্ভব হতোনা।"
প্রাইভেট হাসপাতালে কম খরচে সেবা পেয়ে রুমা বেগমের মত সন্তুষ্ট অনেক রোগী। মিরপুর ১৭ নম্বর সেক্টরে এক একর জায়গার ওপর অবস্থিত অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) হসপিটাল।
এ হাসপাতাল নরমাল ডেলিভারি, সিজারিয়ান ডেলিভারি, ল্যাপারোস্কপিসহ সব ধরনের গাইনোকলজিক্যাল অপারেশন করা হয় তুলনামূলক কম খরচে। পাশাপাশি কৈশরকালীন স্বাস্থ্যসেবা, নবজাতকদের স্বাস্থ্যসেবা, সার্ভিক্যাল ক্যান্সার নির্ণয়ে ভিআইএ টেস্ট, পরিবার পরিকল্পনা সেবাসহ বিনামূল্যে বিভিন্ন সেবা দেওয়া হয়।
মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবায় ভালো করার জন্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওজিএসবি হসপিটাল অ্যান্ড আইআরসিএইচ-কে ফাইভ স্টার ফ্যাসিলিটি সার্টিফিকেট দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সোমবার সকালে হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, ৫ তলা হাসপাতালটির নিচতলায় অভ্যর্থনা ডেস্ক, পাশেই ওষুধের দোকান। নিচ তলায় এএনসি কর্নার। দুই তলায় আউটডোর, ভায়া সেন্টার, অপারেশন থিয়েটর। এর পরের বাকি ফ্লোরগুলোতে ওয়ার্ড, কেবিন, এনআইসিইউ।
পরিচ্ছন্ন হাসপাতালটির চারদিকে অনেক খোলামেলা। তবে হাসপাতালটিতে রোগীর ভিড় একেবারে কম।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, দেড়শো বেডের হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকে ৩৫-৪০ জন। আর আউটডোরে প্রতিদিন ৮০-১০০ জন সেবা নেয়।
তবে ২১ ফেব্রুয়ারি, নারী দিবস, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনসহ বিশেষ দিবসগুলোতে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দেওয়া হয় বলে সেসব দিনে ২০০ করে রোগী সেবা নেয় আউটডোরে।
ওজিএসবি হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সিরাজুল কাদির (অব.) টিবিএসকে বলেন, "আমাদের সক্ষমতা আছে, আরো রোগী আসলে সেবা দিতে পারবো। প্রচার প্রচারণার অভাবে আমাদের হাসপাতালে রোগী কম।"
"আমার রোগীরাই হাসপাতালের প্রচার করে। কম খরচে ভালো সেবা পেয়ে সুস্থ হয়ে যারা ফিরে যায় তারাই অন্য রোগীকে এ হাসপাতালের কথা বলে," যোগ করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, "আমাদের হাসপাতাল থেকে কোনো গরিব রোগী ফেরত যায়না। গরিব রোগীদের সামর্থ অনুযায়ী ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়। যাদের ওষুধ কেনার টাকা নেই তাকে হাসপাতালে যাকাত ফান্ড থেকে ওষুধ কেনার টাকা দেওয়া হয়।"
তিনি আরো জানান, যাদের ডিসকাউন্ট দেওয়া হয় তাদের নাম, মোবাইল নাম্বার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে পাঠানো হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথ্য যাচাই বাছাই করে। প্রতি মাসে ৫ লাখের বেশি টাকা ডিসকাউন্ট দেওয়া হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
চার মাস বয়সী মেয়ে রাবিয়া জান্নাতকে নিয়ে শিশু ডাক্তার দেখাতে এসেছেন একটি কোচিংয়ের শিক্ষক রুমানা বেগম। টিবিএসকে তিনি বলেন, "এই হাসপাতালেই গর্ভকালীন সেবা নিয়েছি। নরমাল ডেলিভারির চেষ্টা করা হয়েছিলো কিন্তু নরমালে না হওয়ায় সিজারে বাচ্চা জন্ম নেয়। সিজার খরচ, ওষুধ, তিনদিন হাসপাতালের বিলসহ খরচ হয়েছে ৪০ হাজার টাকা।"
"আজকে মেয়েকে ২৫০ টাকায় কনসালটেন্ট দেখালাম, অন্য কোন বেসরকারি হাসপাতালে তো এতো কম টাকায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে পারতাম না," বলেন তিনি।
প্রিম্যাচিউর নবজাতকদের জন্য রয়েছে ১০ বেডের এনআইসিইউ
পরামর্শক ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. সুমন পারভেজ বলেন, "আমাদের এনআইসিইউতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আছে। এখানে এনআইসিইউতে দিনে ৫-৬ হাজার টাকা নেওয়া হয়, যেখানে অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয় ১০-২০ হাজার টাকা।"
"খরচ কম হওয়ায় এ হাসপাতালে জন্ম নেওয়া নবজাতকদের পাশাপাশি অন্যান্য হাসপাতাল থেকেও নবজাতক এনে এ হাসপাতালে রাখা হয়। প্রিম্যাচিউর ও পোস্ট ম্যাচিউর নবজাতকদের এখানে রাখা হয়," যোগ করেন তিনি।
হাসপাতালের আউটডোরে প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত ২০০-৩৫০ টাকায় গাইনি ও শিশু বিশেষজ্ঞদের সেবা নিতে পারেন রোগীর। বিকেলে সিনিয়র প্রফেসররা স্বল্পমূল্যে রেফার্ড রোগীদের দেখেন।
হাসপাতালের সমস্যা সমাধান-মূল্যায়নে নেওয়া হয় রোগীর মতামত
ওজিএসবি হাসপাতালে কোন রোগী চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় তাকে একটি ফরম ফিলআপ করতে হয়। ফরমে হাসপাতালের পরিবেশ, সেবার মান, ডাক্তারের ব্যবহার, কোন সমস্যা হয়েছে কিনা, মান উন্নয়নে কী করা উচিৎ- সে বিষয়ে ১১টি প্রশ্ন থাকে।
রোগীদের কাছ থেকে পাওয়া এসব প্রশ্নের উত্তরের ওপর ভিত্তি করে হাসপাতালের সমস্যার সমাধান করা হয় ও স্টাফদেরকে বছর শেষে পুরস্কার দেওয়া হয়।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সিরাজুল কাদির বলেন, "আমার কী করা প্রয়োজন তা আমি রোগীদের কাছ থেকে জানতে পারি। হাসপাতালে মশার উপদ্রবের কথা রোগীরা ফর্মে লিখেছিল। তারপর আমি একটি ফগার মেশিন কিনেছি। রোগীদের চোখেই আমি ডাক্তার ও অন্যান্য স্টাফদের মূল্যায়ন করি।"
হাসপাতালটি পরিচালনা করে ওজিএসবি সোসাইটি
যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়ানো ও মাতৃমৃত্যু কমিয়ে আনতে ১৯৭১ সালে ওজিএসবি এর যাত্রা শুরু হয়। এর পর থেকেই নারী স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করছে সংগঠনটি।
ওজিএসবি বাংলাদেশের একমাত্র সোসাইটি যারা নিজেদের টাকায় হাসপাতাল নির্মাণ করেছে।
১৯৯৫ সালে মিরপুর-১-এ প্রথম হাসপাতাল করে ওজিএসবি। সেখানে নিম্ন আয়ের মানুষকে অল্প পয়সায় চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। পরে ২০১১ সালে মিরপুর-১৭ তে এক একর জায়গার ওপর দেড়শো বেডের এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
হাসপাতালের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সামিনা চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "এটি একটি অলাভজনক হাসপাতাল। তাই আমরা স্বল্পমূল্যে সেবা দিতে পারি। ওজিএসবির ২৫০০ সদস্যের সবাই কিছু না কিছু কন্ট্রিবিউট করে হাসপাতালে।"
সিনিয়র সদস্যরা বেশি কন্ট্রিবিউট করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "সিনিয়র সদস্যরা বিভিন্ন ট্রেনিং থেকে যে টাকা পায় সেটা হাসপাতালের ফান্ডে জমা দেয়। সরকারও আমাদের কিছুটা সহযোগীতা করে। এছাড়া ওজিএসবির নার্সিং ইনস্টিটিউটের পুওর ফান্ডে টাকা দিয়ে নার্সিং স্টুডেন্টদের সাপোর্ট দেয় মেম্বাররা।"