এখনও ক্রীতদাসের জীবন যাদের...
'দেশে সবকিছুর দাম বাড়ছে। কত উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মজুরি বাড়ছে না। আমাদের কোনো উন্নতি নেই। আমরা কি মানুষ না?' প্রশ্ন চা শ্রমিক রতন বাউরির। প্রশ্ন নয়, যেন ক্রোধ, আক্ষেপ আর হতাশা ঝরছিল। রতন সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানের শ্রমিক। দৈনিক ১২০ মজুরি পান। তা দিয়েই চলে সংসার।
'এত অল্প টাকায় কীভাবে চলে?'–এই প্রশ্নে আরো ক্ষুব্ধ হন রতন। বললেন,'কীভাবে যে চলে, আপনারা বাবুরা তা বুঝবেন না। চলে না আসলে। বেঁচে আছি যদিও, কিন্তু এটা মানুষের জীবন না। নিজেদের কথা বাদ দিন, বাচ্চাদের কোন শখ-আহ্লাদও জীবনে পূরণ করতে পারিনি। তারাও এখন এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ফলে তারাও আর বড় হতে পারবে না। চা শ্রমিকই থাকবে।'
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা শ্রমিকদের সঙ্গে আন্দোলন চলাকালে একদিন সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানের সামনে গিয়ে কথা হয় রতন বাউরির সঙ্গে। ওই বাগানের সামনে বিক্ষোভ করছিলেন আশপাশের আরও কয়েকটি বাগানের শ্রমিকরা।
সেখানেই আলাপ হয় খাদিমনগর চা বাগানের শ্রমিক সুশিলা রাজভরের সঙ্গেও। সুশীল বলেন, 'আমার ২ ছেলে, তিন মেয়ে, সাথে শ্বশুর-শাশুড়ি থাকেন। এত বড় পরিবার স্বামীর আয়ে চলে না। তাই আমাকেও কাজ করতে হয়। কিন্তু এখন দুইজনের আয়েও সংসার চলছে না।'
'এই টাকায় কীভাবে খেয়ে-পরে বাঁচব? ওষুধপত্র, কাপড়চোপড় কিংবা বাচ্চাদের পড়ালেখা—এসবের খরচ আসবে কোথা থেকে?'
দেশের অন্যতম উৎপাদনশীল খাত চা বাগান। চা একসময় রপ্তানিমুখী পণ্যও ছিল। এখন উৎপাদন অনেক বেড়েছে। তবে দেশের বাজার বড় হয়ে ওঠায় কমে এসেছে রপ্তানি। আর একেবারে শুরু থেকেই অবহেলিত এ খাতের শ্রমিকরা। বাগানগুলোতে 'ক্রীতদাসের' মতো যুগ যুগ ধরে শ্রম দিয়ে আসছেন তারা। মজুরি পান সামান্যই।
এই বাজারেও একজন চা শ্রমিক দৈনিক মজুরি পান ১২০ টাকা। এমনকি সেটিও কেবল নির্দিষ্ট পরিমাণ পাতা উত্তোলন করলেই পাওয়া যায়। অসুস্থতা বা অন্য কোনো সমস্যায় কাজ করতে না পারলে মিলে না মজুরি। ফলে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে শ্রমিকদের।
প্রায় ১০ দিন দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন চালিয়েছিলেন চা শ্রমিকরা। দেশের ১৬৬টি বাগানে শুরু করেছিলেন অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। ধর্মঘট চালাকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভও করেছেন তারা। এরপর শ্রীমঙ্গলে শ্রম দপ্তরের কর্মমকর্তাদের সঙ্গে বাগান মালিক ও শ্রমিক নেতাদের বৈঠক হলেও কোনো সমাধান না আসায় আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিলেন চা শ্রমিকরা। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করার পর কাজে ফেরেন তারা।
এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই কথা হয় সিলেটের বিভিন্ন বাগানের কয়েকজন চা শ্রমিকদের সাথে। নিজেদের মানবেতর জীবন ও কষ্টের কথা জানান তারা।
লাক্কাতুরা চা বাগানের শ্রমিক রতন হাজরা। রতন আক্ষেপ করে বলেন, 'আমরা চা পাতা তুলি। কিন্তু চা খেতে পারি না। চায়ের কাপ এখন ১০ টাকা হয়ে গেছে। যে মজুরি পাই, তা দিয়ে চা কিনে খাওয়া বিলাসিতা হয়ে গেছে।'
গত একমাসেও ঘরে মাংস রান্না হয়নি বলে জানালেন লাক্কাতুরার পাশের মালনীছড়ার চা বাগানের শ্রমিক শিউলি কন্দ। তিনি বলেন, 'ব্রয়লার মুরগীর কেজিও এখন ২০০টাকা। এত দাম দিয়ে মাংস কেনার সামর্থ্য আমাদের নেই। মাছ-ডিম খাওয়াও সম্ভব হয় না।'
বাচ্চাদেরও কখনো সকালের নাস্তা দিতে পারেন না জানিয়ে শিউলি বলেন, 'তারা ভাত খেয়েই স্কুলে যায়। অবার স্কুল থেকে এসে ভাত খায়।'
চা শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, দেশের ১৬৬টি চা বাগানে দুই লক্ষাধিক শ্রমিক রয়েছেন। প্রতি দুই বছর অন্তর চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদ ও শ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে শ্রমিকদের মজুরি পুনর্নির্ধারণ করা হয়। ২০১৯ সালে চা শ্রমিকদের মজুরি ১৮ টাকা বাড়িয়ে ১২০ টাকা নির্ধারণ করে মালিকপক্ষ।
চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, গত দুই মাসে মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রমিক নেতাদের একাধিক বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে শ্রমিকরা মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু মালিকপক্ষ তা মানেনি তখন। পরে এই দাবিতে চা শ্রমিকরা স্মারকলিপি দেন। এতেও কোনো সাড়া না পেয়ে ৮ আগস্ট থেকে আন্দোলন শুরু করেন। এরপর মালিকপক্ষ ও শ্রমিক নেতাদের নিয়ে সমঝোতা বৈঠক আহ্বান করে বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তর। এতে শ্রমিক নেতারা গেলেও মালিকপক্ষের কেউ যাননি।
এরপরই দেশের সবগুলো চা বাগানের ধর্মঘট শুরু করেন শ্রমিকরা।
মালিকপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে বাগানগুলো পরিচালনা করেন বাগান ব্যবস্থাপকরা। তারা শ্রমিকদের সঙ্গে সমন্বয় করে থাকেন।
আকিজ গ্রুপের মালিকানাধীন মৌলভীবাজারের বাহাদুরপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. আব্দুল জব্বার শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে কোনো মন্তব্য না করেই বলেছিলেন, 'আমরা শ্রমিকদের কেবল মজুরি দেই না। রেশন হিসেবে একজন শ্রমিককে সপ্তাহে সাড়ে ৩ কেজি করে চাল দেয়া হয়। এক শ্রমিকের পরিবারের চারজন সদস্য এই রেশন পেয়ে থাকেন। শ্রমিকদের সন্তানদের বয়স ১৮ বছর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই রেশন দেয়া হয়।
'বাগান কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থা করে। তাদের চিকিৎসা ও সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষার সুবিধাও বাগানের পক্ষ থেকে করা হয়। তাদের খাবার পানির ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া যেসব নারী শ্রমিকদের ছোট বাচ্চা রয়েছে সেসব বাচ্চা দেখাশোনার ব্যবস্থাও বাগানের পক্ষ থেকে করা হয়। বয়স্ক শ্রমিকদের অবসরকালীন ভাতা দেওয়া হয়। আবার একজন শ্রমিক দিনে ২৪ কেজির বেশি পাতা তুললে তারা কেজিপ্রতি ৪ টাকা করে বাড়তি মজুরিও পেয়ে থাকেন। ফলে তারা কেবল ১২০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন, এমন দাবি সত্য নয়।'
একই ধরনের কথা বলেছিলেন চা শিল্পের উদ্যোক্তা ও সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আফজাল রশীদ চৌধুরীও। তিনি বলেছিলেন, 'সব সুবিধা মিলিয়ে একজন শ্রমিকের পেছনে আমাদের দৈনিক ৪৫০ টাকা খরচ করতে হয়। বাগানে দিন দিন শ্রমিক বাড়ছে। কিন্তু সেই অনুপাতে উৎপাদন বাড়ছে না। আবার কোনো শ্রমিককে আমরা বের করে দিতেও পারি না। তাদের আবাসন ব্যবস্থাসহ সব ব্যয়ভার বহন করতে হয়। এসব খরচ মিটিয়ে চা বাগান থেকে লাভ বের করে আনাই কষ্টকর। অনেক বাগানই এখন লোকসানে আছে।'
মালিকপক্ষের এমন দাবির সাথে দ্বিমত জানিয়ে প্রসঙ্গে সিলেটের কালাগুল চা বাগানের শ্রমিক সঞ্জয় মাহালি বলেন, 'বাগানে প্রাইমারি স্কুল থাকলেও এগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। বেশিরভাগ বাগানে এক শিক্ষক দিয়েই স্কুল চলে। আবার প্রাথমিকের পর বাচ্চাদের পড়ালেখা নিজ খরচেই করাতে হয়। একটি মেডিকেল সেন্টার থাকলেও সেখানে কোনো ডাক্তার নেই। প্যারাসিটামল ছাড়া কোনো ওষুধ পাওয়া যায় না। ফলে জ্বর-সর্দি ছাড়া কোনো অসুখ হলেই বাইরের ডাক্তারের কাছে যেতে হয়।'
চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, 'অনেক বাগানে রেশনের নামে শ্রমিকদের শুধু আটা দেওয়া হয়। অথচ আমাদের চুক্তিতে আছে, ছয় মাস চাল এবং ছয় মাস আটা দেয়া হবে। কিন্তু সেটাও তারা মানছে না। এছাড়া চিকিৎসা ও শিক্ষার সুবিধা একেবারেই নামমাত্র। এইসব সেবা বাইরে থেকেই আমাদের নিতে হয়।'
রেশনের সঙ্গে মজুরির কোনো সম্পর্ক নেই উল্লেখ করে চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেছিলেন, 'রেশন হিসেবে বাগান থেকে কিছু চাল বা আটা দেয়া হয় তাদের। কিন্তু একজন শ্রমিক কি কেবল চাল খেয়েই বাঁচবে নাকি প্রশ্ন করেছিলেন তিনি। বাকি খাবার কেনাও তো এত কম টাকায় সম্ভব নয়।'
'চিকিৎসা, শিক্ষা, পোষাক এসব কীভাবে ব্যবস্থা করবে চা শ্রমিকরা?
'এই যুগে এসে একজন মানুষকে ১২০ টাকায় সারাদিন খাটানো হয়—এটাই তো চরম অমানবিক।'