শেখ হাসিনা: বাঙালি জাতির আলোকবর্তিকা
২৮ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর রক্তের ও আদর্শের উত্তরাধিকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার জন্মদিন। ১৯৪৭ সালের এই দিনে তিনি পৃথিবীর আলোতে আসেন। শেখ হাসিনার জীবনকাল আর বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। শেখ হাসিনাকে বলা যেতে পারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি ঘটনার সাক্ষী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। ১৫ আগস্টের পর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি আবার ক্ষমতায় আসে। মূলত বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় পরিচালিত হতে শুরু করে। ১৫ আগস্টের পর বীর মু্ক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী হয় চরম নির্যাতনের শিকার। সে যেন স্বাধীন দেশে পরাধীনতার শৃঙ্খল।
শেখ হাসিনাকে সৃষ্টিকর্তা সেদিন হয়তো বাঁচিয়েছিলেন বাঙালি জাতির ত্রাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ বাঙালি জাতি বিশ্ব দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এ পথ ছিল কন্টকময়, দুস্তর পারাবার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ঘাতকদের ষড়যন্ত্র আর অনিরাপত্তার কারণে পরিবারের সবাইকে হারানোর পরও দীর্ঘ ছয় বছর দেশে ফিরতে পারেননি বঙ্গবন্ধুকন্যাদ্বয়। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই নেতাকর্মীরা কাউন্সিলের মাধ্যমে তাঁকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করে। ১৯৮১ সালের ছয় বছর নির্বাসনে থাকার পর সকল ষড়যন্ত্র, সকল বাধাকে উপেক্ষা করে তিনি দেশে ফিরে আসেন বাঙালি জাতির আলোকবর্তিকা হয়ে। ক্রমান্বয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত বাঙালি জাতি আবার প্রাণ ফিরে পায়। প্রতিকূলতার মধ্যেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একসময় চাঙ্গা হয়ে ওঠে; নতুন করে দেশ গড়ার প্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে ওঠে।
বহু ভাগে বিভক্ত নেতা-কর্মীদের তিনি একত্রিত করে মনোনিবেশ করেন গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলনে। প্রতিটি মূহুর্তে শত্রুর গুলির নিশানা উপেক্ষা করে তিনি চষে বেড়িয়েছেন সারা দেশ। শেখ হাসিনা সবচেয়ে দুঃসময়ে দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যেই জনগণের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেন। হয়ে ওঠেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা। স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের হাতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর বাংলার ভাগ্যাকাশে যে কালো অন্ধকার গ্রাস করেছিল, সেই অন্ধকার দূর করতে শুধু আলোর মশালই জ্বালাননি শেখ হাসিনা, সকল সংকট-সীমাবদ্ধতা মোকাবেলা করে আলোকিত করেন বাংলাকে, রাহুমুক্ত করেন বাঙালি জাতিকে।
শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় সাংগঠনিক সফর করেন। এমনকি অনেক ইউনিয়নেও কর্মীসভা, পথসভা এবং জনসভা করেন। সারা দেশে চারণের বেশে ঘুরে বেড়ানোর সময় তিনি গভীরভাবে লক্ষ্য করেন গণমানুষের জীবনযাত্রা, স্থানীয় সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস এবং রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দুরবস্থা। তখন থেকেই তিনি ভাবতে থাকেন কিভাবে দূর করবেন দরিদ্রতা, সমাজের কুসংস্কার এবং উন্নত করবেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট নির্মাণসহ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের পর রাষ্ট্রনায়কের মত তিনি তার ভাবনাগুলোকে আজ একে একে বাস্তবায়িত করে চলেছেন এবং রাষ্ট্রকে এক উচ্চমাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন।
১৯৯৬ সালে তাঁর নেতৃত্বে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। এ জয় শুধু একটি নির্বাচনে জয় ছিল না । এ ছিল নিজ দেশে পরাধীনতার শেকল ভাঙা। দেশকে আবার স্বাধীন করা। স্বাধীনতাবিরোধীদের হাত হতে দেশকে মুক্ত করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আবার দেশকে ফিরিয়ে আনা। এরপর ২০০৮ সালে দ্বিতীয়, ২০১৪ সালে তৃতীয় ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণ, বিকাশ, এবং মুক্তির লক্ষ্যে অগ্রণী হিসেবে কাজ শুরু করেন। শেখ হাসিনার সততা, নিষ্ঠা, দৃঢ় মনোবল, প্রজ্ঞা এবং অসাধারণ নেতৃত্ব বাংলাদেশকে বিশ্ব অঙ্গনে এক ভিন্ন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে যে অসম্ভব কাজটি সম্ভব করেছিলেন তা হলো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার এবং পরে ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। আর এতে সুযোগ এসেছিল বাঙালি জাতির মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে আবার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
বঙ্গবন্ধুর সাহসী কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে এখন আওয়ামী লীগ একটানা ১৪ বছর ক্ষমতায় রয়েছে এবং তিনি জনগণের কল্যাণে নিবেদিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। ৪১ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। এটি একটি অনন্য অর্জন। শেখ হাসিনার অদম্য শক্তি, সাহস, মনোবল এবং দৃঢ় নেতৃত্ব বিশ্বকে অবাক করে। দলের একজন নেতাকর্মীও মনে করে না যে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প আছে। এটি একজন রাজনৈতিক নেতার অসাধারণ প্রাপ্তি। আর সে কারণেই তারা মনে করে যে শেখ হাসিনার বিকল্প একমাত্র শেখ হাসিনাই।
শেখ হাসিনার সাফল্যের সবচেয়ে বড় দিক হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তিনি চারটি মাইলফলক দিয়েছেন। প্রথমটি হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ, যা এরই মধ্যে একটি পর্যায়ে এসেছে। দ্বিতীয়টি ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করা, তৃতীয়টি ২০৪১ সালে একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়া এবং চতুর্থটি ২১০০ সালের ডেলটা প্ল্যান বাস্তবায়ন। তিনি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে রূপ দিয়েছেন। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু থেকে শুরু করে বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা এলডিসি হতে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হয়েছি । নির্বাসিত '৭২ এর সংবিধানে ফেরত এসেছি এবং '৭১ এর মানবতা বিরোধী অপরাধ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে । প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল নির্মাণ, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, মাতারবাড়ি প্রকল্প, সমুদ্র বিজয়, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি, প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দানের মাধ্যমে মানবতার নব দিগন্ত উন্মোচন, গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, সর্বোপরি করোনা পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করে দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। যে পাকিস্তান আমাদের প্রতি শোষণ নির্যাতন করে নিজেদের উন্নতি করে ছিল তারা আজ যেকোন সূচকেই বাংলাদেশের অনেক পেছনে রয়েছে। আজ বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল।
আজ 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' এর সুবিধা শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের অর্থনীতি এবং সামগ্রিক উন্নয়ন হচ্ছে দ্রুতগতিতে। ২০০৮-০৯ সালে গ্রস ডমেস্টিক প্রডাক্টের (জিডিপি) পরিমাণ ছিল মাত্র ১০৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১-২২-এ এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১৬.২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৮-০৯ সালে রপ্তানি আয় ছিল ১৫.৫৬ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১-২২ সালে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৮.৪৬ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছেছিল। যদিও করোনার প্রকোপ কম-বেশি হচ্ছে, তবে এখনও মজবুত অবস্থনে রয়েছে। ২০০১ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৭.৯ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৪.৩ শতাংশ। ২০২০ সালে দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ১০.৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে প্রায় ২৯ বছরই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় ছিল। এ ২৯ বছর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল উপেক্ষিত এবং বিসর্জিত। জাতীয় চার মূলনীতি ছিল অবাঞ্চিত। এ ২৯ বছর বাংলাদেশ চলেছে উল্টো পথে। এজন্য বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যদি বাংলাদেশ পুরো ৫০ বছর পরিচালিত হতো, তাহলে বাংলাদেশ অনেক আগেই উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতো।
শেখ হাসিনা শুধু উন্নতই করছেন না, বাঙালি জাতিকে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিশ্বব্যাংক যখন বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নিয়ে আপত্তি ও দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ করেছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ কারও প্রেসক্রিপশনে চলে না। শুধু পদ্মা সেতু নয়, মেট্রো রেল, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন দৃশ্যমান উন্নয়ন এখন বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদার এক অনন্য জায়গায় নিয়ে গেছে, যেটি একমাত্র শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছে।
শেখ হাসিনা শূন্য থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার পথে নিয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"। বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছেন রাজনৈতিক মু্ক্তি, আর শেখ হাসিনা জাতিকে দিচ্ছেন অর্থনৈতিক মুক্তি।
বাঙালি জাতির আলোকবর্তিকা ও ত্রাতা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে জন্মদিনের আন্তরিক সশ্রদ্ধ শুভেচ্ছা।
লেখক: স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।