ধীরগতির নিষ্পত্তিতে অর্থ পাচার মামলার স্তূপ জমে উঠছে
অর্থ পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) বিভিন্ন সরকারি সংস্থার দায়ের করা মামলার সংখ্যা বছরের পর বছর ধরে ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু এসব মামলা নিষ্পত্তির হার একেবারেই কম।
সূত্রমতে, দেশে ২০০৩ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট অর্থ পাচারের মামলা দায়ের হয়েছে ৯৭৬টি। এসব মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২০৩ টির।
এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে অর্থ পাচারের মোট ৩২২টি মামলা দায়ের করা হয়। আর ২০১৬ সালে যে পরিমাণ মামলা দায়ের করা হয়, ২০২১ সালে তার দ্বিগুণ মামলা দায়ের করা হয়েছে। অথচ এই সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৬৪ টি মামলা।
প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা ৮৫৬টি মামলা বছরের পর বছর ধরে সারা দেশের বিভিন্ন বিচারিক আদালতে ঝুলে আছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ অর্থ পাচার মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতির জন্য মূলত জনবল, অভিজ্ঞতা এবং সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় দুদকসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের তদন্তে বিলম্ব হওয়াকে দায়ী করেছেন।
অন্যদিকে বিচার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হওয়ার কারণ তুলে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মঈদুল ইসলাম বলেন, 'মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলাগুলোর বিচার হয় বিশেষ জজ আদালতে। এসব আদালতে মানি লন্ডারিং আইনের মামলা বিচারের পাশাপাশি, দুর্নীতিসহ নানা অপরাধেরও বিচার হয়। মিানি লন্ডারিং মামলাগুলোয় বিশেষ নজর দিতে পারে না আদালতগুলো।'
একই অবস্থা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগেও। সেখানে অর্থ পাচারের বেশ কিছু আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে বছরের পর বছর।
শফিক আহমেদ অর্থ পাচারের মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করতে জনবল বৃদ্দির পাশাপাশি কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির পথ বের করার ওপর জোর দেন।
আর মঈদুল ইসলাম বলেন, কিছু নিম্ন আদালতকে শুধু এসব মামলায় বিচার করার জন্য নির্দিষ্ট করে দিলে দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব। এছাড়া উচ্চ আদালতে একটি বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দ্রুত আপিল নিষ্পত্তি সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার অধ্যাদেশ জারি করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা এবং তদন্ত করার এখতিয়ার দেয়। এর আগের বিধান ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ মামলা তদন্ত করবে।
২০১৫ সালে আইনটি সংশোধন করে এ-সংক্রান্ত অপারাধের মামলা দায়ের ও তদন্তে দুদকসহ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), কাস্টমস বিভাগ এবং মাদ্রক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে এখতিয়ার দেওয়া হয়।
দুদকসহ এসব প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা ৭৭৩টি মামলার বিচার বছরের পর বছর ধরে ঝুলে রয়েছে। এর মধ্যে দুদকের দায়ের করা মামলার পরিমাণ ৪১৭।
যেভাবে বিচারে বিলম্ব
হংকংয়ে ৩২১ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর গুলশান থানায় বিএনপি নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান এবং তার ছেলে ফয়সাল মোরশেদসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
ওই মামলায় ২০১৫ সালে আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে দুদক। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ২০১৫ সালে দুদকের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে আদেশ দেন।
পরবর্তীতে এই মামলা পুনরায় তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করে দুদক।
দুদকের আইনজীবী খোরশেদ আলম খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে এই মামলা পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে মোরশেদ খানসহ অন্য আসামিদের বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে আসামিরা বিচারিক আদালতে আত্মসমপর্পণ করে জামিন নেন।
এখন পর্যন্ত মামলাটির পুনঃতদন্ত সম্পন্ন হয়নি বলে জানান খোরশেদ আলম।
আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে রাজধানীর গুলশান থানায় ব্যবসায়ী মনিরুল কবিরের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে। মামলায় অভিযোগ ছিল, তিনি ভুয়া চালানের মাধ্যমে ৪৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা কানাডায় পাচার করেছেন।
আইন প্রনয়ণের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই মামলা দায়ের হয়।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ব্যবসায়ী মনিরুল কবিরকে একমাত্র অভিযুক্ত করে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।
২০০৭-এর ফেব্রুয়ারিতে এই অভিযুক্তকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন ঢাকা মহানগর জেলা জজ আদালত।
এরপর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধন করে বিচারের এখতিয়ার দেওয়া হয় বিশেষ জজ আদালতকে।
২০০৭ সালের নভেম্বর নাগাদ মামলাটি বদলি হয় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-২-এ।
মামলাটিতে ছয়জন সাক্ষীর নাম থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণের পর এখন পর্যন্ত তাদের একজনও সাক্ষ্য দিতে আদালতে যাননি। মামলার বিচার ঝুলে আছে ১৯ বছর ধরে।
দুদকের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম টিবিএসকে বলেন, এই মামলায় কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা সাক্ষী ছিলেন। তাদের বেশিরভাগই অবসরে গেছেন, দুজন মারা গেছেন।
তবে আগামী বছর শুরুর দিকে এই মামলার দিন ধার্য আছে জানিয়ে তিনি বলেন, মামলাটি কীভাবে দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়, সে বিষয়ে আদালতের কাছে বক্তব্য উপস্থাপন করা হবে।
মীর আহমেদ আলী বলেন, ব্যাংকের নথিপত্র অনুযায়ী মামলার পলাতক এই আসামির ঠিকানা গুলশান এভিনিউ দেখানো হলেও, আসামির কোনো হদিস নেই। আসামি যে ঠিকানা ব্যবহার করেছেন, সেটিও ভুয়া।
আসামি কারা?
সূত্রমতে, ২০০৭ সাল থেকে এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিচারিক আদালতগুলোতে ৭৭৩টি মামলা ঝুলে আছে। আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সাল থেকে বিচারাধীন ৭৭৩টি মামলায় ১ হাজার ৫০৮ জন আসামি রয়েছেন। আসামিদের মধ্যে ৯১১ জন ব্যবসায়ী, ২০৮ জন রাজনীতিবিদ এবং ১১৪ জন সরকারি কর্মকর্তা আছেন।
এদিকে দুদক সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৬৯৭ জনের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। সন্দেহভাজনদের মধ্যে ২৩৪ জন ব্যবসায়ী, ১২৮ জন রাজনীতিবিদ এবং ২২৯ জন সরকারি কর্মকর্তা।
সবচেয়ে বেশি আসামি ব্যবসায়ী কেন?
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, 'এলসি বা চালানের মাধ্যমে টাকা পাচার হলো সবচেয়ে সহজ উপায়, যেটি অবলম্বন করে থাকে পাচারকারীরা। এলসি বা চালান করতে হলে ব্যবসার জন্য আমদানির অনুমোদন থাকতে হয়। ফলে ব্যবসায়ীরা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে বেশি জড়িত।'
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারির কারণে এটি অনেকটা কমে আসছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান অবশ্য বলেন, দেশে পাচারের অর্থের সঠিক হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়া সরকারের অন্য কোনো সংস্থা নিরূপণ করতে পারে না।
তিনি বলেন, যারা দেশের টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত, তারা নানাভাবে সবসময় সরকারের বিভিন্ন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে জড়িত থাকে। ফলে যখন যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা বিচারের বাইরে থেকে যায়।