দেশে ৬৩.৫১% নারী অনলাইন সহিংসতার শিকার: সমীক্ষা
একশনএইড বাংলাদেশ-এর করা এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, দেশের ৬৩.৫১ শতাংশ নারী অনলাইন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
১৬ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ উদযাপন উপলক্ষে ২৭ নভেম্বর ব্র্যাক সেন্টার ইন-এ একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত 'অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা: বাধা এবং উত্তরণের উপায়' শীর্ষক আলোচনা সভায় সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
দেশে অনলাইন সহিংসতার হার জানার জন্য একশনএইড এই সমীক্ষাটি পরিচালনা করা হয়। সমীক্ষায় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নারীরা যেসব নানা ধরনের সহিংসতা এবং হয়রানির শিকার হন, তা চিহ্নিত করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। পাশাপাশি এসব সহিংসতার পেছনের মূল কারণ ও অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে সচেতনতার জন্য বিভিন্ন পন্থাও উপস্থাপন করে সমীক্ষাটি।
সাতক্ষীরা , সুনামগঞ্জ , পটুয়াখালী, বান্দরবান , কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট—এই ৬ জেলায় একটি অনলাইন জরিপের মাধ্যমে এই সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়। ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সি ৩৫৯ জন নারী এ জরিপে অংশ নেন।
সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ২০২২ সালে বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মধ্যে নারীরা বেশিরভাগই ফেসবুকে (৪৭.৬০%), মেসেঞ্জারে (৩৫.৩৭%), ইনস্টাগ্রামে (৬.১১%), ইমোতে (৩.০৬%), হোয়াটসঅ্যাপে (১.৭৫%) এবং ইউটিউবে (১.৩১%) অনলাইন সহিংসতার শিকার হন। 'অন্যান্য' মাধ্যমে ৪.৮০ শতাংশ নারী বলেছেন, তারা ভিডিও কল, মোবাইল ফোন ও এসএমএসের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন।
এ বছরের সমীক্ষায় দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ৮০.৩৫ শতাংশ নারী অনলাইন সহিংসতার মধ্যে ঘৃণ্য এবং আপত্তিকর যৌনতাপূর্ণ মন্তব্য, ৫৩.২৮ শতাংশ নারী ইনবক্সে যৌনতাপূর্ণ ছবি গ্রহণ এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব, ১৯.১৭ শতাংশ নারী বৈষম্যমূলক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন।
১৭.৪৭ শতাংশ উত্তরদাতারা বলেছেন যে তাদের নামে অন্য কেউ অনলাইনে নকল আইডি তৈরির ফলে হয়রানির শিকার হয়েছেন। ১৬.১৬ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের কার্যকলাপ সবসময় সাইবার স্পেসে অনুসরণ করা হয়। আর ১৩.১০ শতাংশ উত্তরদাতা সমকামীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
এছাড়া ১১.৭৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাদের ব্যক্তিগত ছবি অনুমতি ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছে এবং ১১.৭৯ শতাংশ উত্তরদাতা যৌন নিপীড়নের হুমকি পেয়েছেন।
৩.০৬ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, যৌন নিপীড়নের সময় তাদের ছবি তোলা বা ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছিল এবং সেগুলো পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হয়েছিল। ২.৬২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন যে তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি গোপনে পোস্ট করা হয় এবং পরে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের হুমকি দিয়ে অর্থের জন্য ব্ল্যাকমেইল করা হয়। ১.৭৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন যে তাদের ছবি সম্পাদনা করে পর্নোগ্রাফি সাইটে প্রকাশ করা হয়।
সমীক্ষায় আরও উঠে এসেছে, অনলাইন সহিংসতার কারণে নারীদের জীবনে সবচেয়ে গুরুতর প্রভাব হলো মানসিক আঘাত, হতাশা এবং উদ্বেগ (৬৫.০৭%)। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রভাব হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় থাকা বা মতামত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আস্থা হারানো (৪২.৭৯%)।
২৫.৩৩ শতাংশ নারী ট্রমার শিকার হয়েছেন এবং ২৪.৮৯ শতাংশ নারী আত্মমর্যাদা হারিয়েছেন।
সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, অনলাইন সহিংসতা ও হয়রানির কারণে সৃষ্ট মানসিক যন্ত্রণা নারীর আত্মবিশ্বাস এবং স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে সংকুচিত করছে।
সমীক্ষাটিতে উঠে এসেছে, ১৪.৯১ শতাংশ নারী অনলাইন সহিংসতার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দিয়েছেন এবং ৮৫ শতাংশেরও বেশি ভুক্তভোগী কোনো অভিযোগ জমা না দিয়ে নীরব ছিলেন।
অভিযোগকারীদের মধ্যে, ৪৪.১২ শতাংশ সোশ্যাল মিডিয়া রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে, ২০.৫৯ শতাংশ পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন-এর ফেসবুক পেজের মাধ্যমে, ১১.৭৬ শতাংশ জাতীয় জরুরি পরিষেবার (৯৯৯) মাধ্যমে, ১১.৭৬ শতাংশ নিকটস্থ থানায়, ৫.৮৮ শতাংশ সাইবার ক্রাইমের ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, সিটিটিসি ও ডিএমপির মাধ্যমে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
সমীক্ষায় আরও জানানো হয়, বেশিরভাগ নারী মনে করেন বিদ্যমান অভিযোগের প্রক্রিয়াগুলো কার্যকর নয়। তাই তারা কোনো অভিযোগ (২৮.৮৭%) জমা দিতে আগ্রহ দেখাননি। সামাজিক কলঙ্ক, ভুক্তভোগী দোষারোপ ও গোপনীয়তা হারানোর ভয়ে ৭৫.৭৭ শতাংশ নারী অনলাইনের মাধ্যমে বেনামে অভিযোগ করতে চান।
সমীক্ষায় উত্তরদাতারা অনলাইন হয়রানি, অপব্যবহার ও ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং দ্রুত শাস্তির পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়াও অনলাইন এবং অফলাইন উভয় মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা, প্রশিক্ষণ এবং নিরাপদ ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার প্রতি অভিমত দিয়েছেন তারা।
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, 'নারীর প্রতি সহিংসতা নতুন কিছু নয় এবং এটি এখনো বিভিন্ন মাধ্যমে বিদ্যমান রয়েছে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন হচ্ছে এবং এর নানা রকম বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে। এর নতুন এক মাধ্যম হলো অনলাইন। এই প্রযুক্তির যুগে অনলাইনে নারীদের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে । বিশেষ করে কিশোরী ও ১৮ বছরের নিচের কন্যাশিশুরা এর শিকার বেশি হচ্ছে । সবাই একত্রিত হয়ে কাজ করলে নারীর প্রতি সহিংসতা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।'
অনলাইন সহিংসতা নিরসনে আইনি প্রক্রিয়ার জোরদারের পাশাপশি প্রযুক্তিগত সহায়তা বেশি দরকার বলে অভিমত প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন।