৮৩% হাসপাতালে চিকিৎসা বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা নেই : টিআইবি
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চিকিৎসা-বর্জ্য তৈরি হয় বাংলাদেশে। তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) থাকা বাধ্যতামূলক হলেও ৮৩% হাসপাতালে ইটিপি নেই। যেসব হাসপাতালে (১৭ শতাংশ) ইটিপি আছে, তাদের ১৬ শতাংশ হাসপাতালে আবার এই ব্যবস্থা সচল নেই।
দেশের ৪৯% হাসপাতালে সিরিঞ্জের সূচ ধ্বংসকারী যন্ত্র ব্যবহার করা হয় না। এর ফলে বিভিন্ন ধরণের সংক্রামক রোগ ও পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি বাড়ছে বলে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার অনলাইনে এক অনুষ্ঠানে 'চিকিৎসা–বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়' শীর্ষক গবেষণার তথ্য প্রকাশ করা হয়। গবেষণাটি পরিচালনা করেন টিআইবির গবেষক নেওয়াজুল মওলা, শহিদুল ইসলাম ও সাজ্জাদুল করিম।
টিআইবি ১৮৮টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ৩৮টি সিটি করপোরেশন-পৌরসভা ও ১২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য নিয়ে গবেষণাটি করেছে। এছাড়া তারা চিকিৎসা-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যুক্ত বিভিন্ন স্তরের ৯৩ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছে। গবেষণার সময়কাল ২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত।
টিআইবি বলছে, হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ ও ঠিকাদারদের একটি চক্র কাচের বোতল, সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ ও প্লাস্টিকের নল, ব্লেড, কাঁচি ধ্বংস না করে পুনঃব্যবহারযোগ্য বর্জ্য সংগ্রহকারী সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করে। এর ফলে এইচআইভি এইডসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ও পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি বাড়ছে। একটি সুপরিচিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কালো বাজারে প্লাস্টিক চিকিৎসা বর্জ্যের অবৈধ ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। একটি জেলার বিভিন্ন হাসপাতালের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কেজি প্লাস্টিক চিকিৎসা বর্জ্য অবৈধভাবে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে।
চিকিৎসা বর্জ্য পরিশোধন ও নষ্ট করার অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে টিআইবি জানিয়েছে, বিধিমালা ২০০৮-এর তফসিল ১ অনুযায়ী চিকিৎসা বর্জ্য পুনঃব্যবহার রোধে রাবার, প্লাস্টিক নল ও বিভিন্ন ব্যাগ টুকরো করে কাটার নির্দেশনা থাকলেও তা পালনে ঘাটতি রয়েছে। সার্বিকভাবে ২৮% হাসপাতালে রাবার ও প্লাস্টিকের ব্যাগ এবং ৩১% হাসপাতালে রাবার, প্লাস্টিকের নল কাটা হয় না।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতার চ্যালেঞ্জ হিসেবে বলা হয়েছে, বর্জ্য সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট রঙের পাত্রের ঘাটতি রয়েছে। চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী বর্জ্য সংরক্ষণের জন্য ৬টি নির্দিষ্ট রঙের পাত্র রাখার নির্দেশনা থাকলেও জরিপকৃত ৬০% হাসপাতালে তা নেই। এসব হাসপাতালের অভ্যন্তরে যত্রতত্র বর্জ্য ফেলা হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে বর্জ্যকর্মী সব ধরনের বর্জ্য একত্রে বালতি বা গামলায় সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে।
বর্জ্যকর্মী নিয়োগে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন
টিআইবির গবেষণা বলছে, সরকারি হাসপাতাল, সিটি করপোরেশন ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিকিৎসা বর্জ্যকর্মী নিয়োগে ২ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা থেকে পর্যন্ত লেনদেন হয়। ৫৫% বর্জ্যকর্মীর নিয়োগ হয় অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে। স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ৪৬%, প্রভাবশালীর হস্তক্ষেপে ৪২% ও সরাসরি ঘুষের মাধ্যমে ১৪% বর্জ্যকর্মীর নিয়োগ হয়। চিকিৎসা বর্জ্যকর্মীদের বেতন প্রদানে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। কর্মী সংকট ও কর্মীদের দক্ষতার ঘাটতির বিষয়টিও উঠে এসেছে গবেষণায়।
ঠিকাদার নিয়োগেও অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। অধিকাংশ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চিকিৎসা বর্জ্য পৃথককরণ, পরিবহন, পরিশোধন ও অপসারণের সঠিক নিয়ম মানেনা।
টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সার্বিকভাবে পরিবেশের ক্ষেত্রে সুরক্ষা ও জনগণের নিরাপত্তার জন্য ওতপ্রোতোভাবে জড়িত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। আমাদের চিকিৎসা-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট আইনে দুর্বলতা আছে। চিকিৎসা-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হয়নি। এই কাজে সমন্বয়ের ঘাটতি আছে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিতে প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয়, তদারকি ও তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করতে 'কর্তৃপক্ষ' গঠন, চিকিৎসা বর্জ্যের ঝুঁকি সম্পর্কে হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসা বর্জ্যকর্মী এবং জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, পুনঃব্যবহারযোগ্য চিকিৎসা বর্জ্যের অবৈধ ব্যবসা বন্ধে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণসহ ১১টি উদ্যোগ নেয়ার সুপারিশ করেছে টিআইবি।