স্মার্ট টিকিট থেকে আধুনিক স্টেশন: কেমন হবে মেট্রোরেল সেবা ও ব্যবস্থাপনা
চলতি মাসের ২৮ তারিখ রাজধানীতে উদ্বোধন হওয়ার কথা রয়েছে ঢাকাবাসীর বহু প্রতীক্ষিত বাণিজ্যিক মেট্রোরেল। রাজধানীর দিয়াবাড়ি থেকে পল্লবী, মিরপুর হয়ে আগারগাঁও পর্যন্ত চলবে ট্রেন। তবে কেমন হবে মেট্রোরেলের আয়, যাত্রী সংখ্যা, ব্যবস্থাপনা ও টিকিট সেবা?
টিকিট ব্যবস্থা যেমন হবে
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে, মেট্রোরেলে দুই ধরনের টিকিটের ব্যবস্থা থাকবে। একটা হলো স্থায়ী কার্ড। এই কার্ড রিচার্জ করে পুরো বছর বা মাসে যাতায়াত করা যাবে। এই কার্ড কিনতে ২০০ টাকা দিতে হবে। এরপর ২০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত রিচার্জ করা যাবে। অনলাইন লেনদেনের মাধ্যমে কার্ড রিচার্জ করা যাবে।
মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশনে থাকা মেশিনেও কার্ড রিচার্জ করা যাবে। প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের সময় যাত্রীদের কার্ড পাঞ্চ করতে হবে। নতুবা দরজা খুলবে না। নেমে যাওয়ার সময় আবার কার্ড পাঞ্চ করতে হবে। নতুবা যাত্রী বের হতে পারবেন না।
আরেকটি কার্ড সাময়িক, যা প্রতি যাত্রায় দেওয়া হবে। স্টেশন থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যের ভাড়া দিয়ে এই কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। এটিও স্মার্টকার্ডের মতো। ভাড়ার অতিরিক্ত যাতায়াত করলে এই কার্ড দিয়ে যাত্রী দরজা খুলতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছে বাড়তি ভাড়া পরিশোধ করে যাত্রীকে বের হতে হবে।
মেট্রোরেলের স্টেশনে লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যাবে। তিনতলা স্টেশন ভবনের দ্বিতীয় তলায় কনকোর্স হল থাকবে। সেখানে টিকিট কাটার ব্যবস্থা, অফিস ও নানা যন্ত্রপাতি থাকবে। তিনতলায় রেললাইন ও প্ল্যাটফর্ম। একমাত্র টিকিটধারী যাত্রীই তিনতলায় যেতে পারবেন। দুর্ঘটনা এড়াতে রেললাইনের পাশে বেড়া থাকবে। স্টেশনে ট্রেন থামার পর বেড়া ও ট্রেনের দরজা একসঙ্গে খুলে যাবে। আবার নির্দিষ্ট সময় পর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হবে।
যাত্রী সংখ্যা, আয় ও কোন সময় থেকে চলবে মেট্রোরেল
মেট্রোরেল প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের প্রথম এই রেল ব্যবস্থায় প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত ২৪ সেট ট্রেন চলবে। যাতে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী এবং প্রতিদিন প্রায় ৫ লাখ যাত্রী যাওয়া-আসা করবে। প্রতিটি স্টেশনে আড়াই থেকে তিন মিনিট পরপর ট্রেন থাকবে। দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাওয়া বা আসার জন্য ৩৮ মিনিট সময় লাগবে। এখন মোটরযানে উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে প্রায় ২ ঘণ্টা বা এর বেশি সময় ব্যয় হয়।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় বলা হয়েছে, উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলে প্রতি বছর যাত্রী সংখ্যায় প্রবৃদ্ধি হবে। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন যাতায়াত করা যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৫ লাখ ৮৮ হাজারে। কিন্তু পরিবহন বিশেষজ্ঞরা এ হারে যাত্রী প্রবৃদ্ধি হবে কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক বলেন, আমরা শুরুর দিকে একটু গ্যাপ দিয়েই ট্রেন পরিচালনা করব। কারণ মেট্রোরেলে চলাচলের জন্য আমাদের দেশের যাত্রীরা অভ্যস্ত না। সেজন্য প্রথম দিকে সকাল ও বিকালে দিনে চার ঘণ্টা করে ট্রেন চলানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যাত্রী সংখ্যা বাড়ার ওপরে নির্ভর করছে পরবর্তীতে সময় কতটুকু বাড়তে পারে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক বলেন, "আমাদের পরিকল্পনা যাত্রীদের টিকিট থেকেই ৭০ শতাংশ আয় করবো। আর বাকি ৩০ ভাগ আয় আসবে যাত্রী আয়-বহির্ভূত খাত থেকে।"
কতটি স্টেশন চালু হচ্ছে
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যতটুকু চালু হচ্ছে সে পথে মোট ৯টি স্টেশন পড়বে। এই ৯ স্টেশনের কাজই শেষ। এখন শুধু মিরপুর এলাকায় দু'টি স্টেশনের সিঁড়ি ও এস্কেলেটরের কিছু কাজ চলমান। এগুলো উদ্বোধনের আগেই শেষ করা হবে। পাশাপাশি এই পথে চালু হতে যাওয়া দশটি ট্রেনই নিয়মিত যাত্রীবিহীন ট্রায়াল দিচ্ছে। এদিকে মেট্রোলের পরিচালনায় থাকবে মোট ২৭৪ জন কর্মী। এদের মধ্যে ট্রেনচালক রয়েছেন ২৪ জন, স্টেশন নিয়ন্ত্রক রয়েছেন ৫৮ জন। এদের মধ্যে চারজন নারী। ট্রেন পুরোদমে চালু হলে আরও জনবলের প্রয়োজন হবে। সে লক্ষ্যে এরইমধ্যে ৪০০ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে।
এ প্রসঙ্গে এমএএন সিদ্দিক বলেন, "উদ্বোধনের জন্য আমরা প্রায় প্রস্তুত। এখন যেটুকু কাজ বাকি রয়েছে তা ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, উদ্বোধনকে ঘিরে এখন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।"
তবে এবার চাকচিক্যময় কোনো উদ্বোধনী আয়োজন করা হবে না বলে জানান তিনি।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, "বিশ্ব অর্থনীতির কথা চিন্তা করে খরচ কম করার নির্দেশনা রয়েছে।"
পরিচালন ব্যয় ও প্রকল্প ব্যয় কত
রাজধানীতে মেট্রোরেল নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। কোম্পানির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উত্তরা থেকে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত যে মেট্রোটি তৈরি হচ্ছে, সেটিতে ট্রেন পরিচালনা করতে প্রতিদিন ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ হবে।
উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল স্থাপনে চলমান এ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিলো ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এরপর কমলাপুর পর্যন্ত যুক্ত হওয়ায় এর ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকায়। এরমধ্যে জাইকা (জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা) ১৯ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা দিচ্ছে আর সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করবে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।