তিন দশক ধরে অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে যশোর পৌরসভার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট
১৯৯০ সালে শহরে আয়রনমুক্ত ও সুপেয় পানি সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে যশোর পৌরসভায় ৩টি ওয়াটার আয়রন ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে তিন দশক। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল পৌনে ৪ কোটি টাকা। অথচ পৌর কর্তৃপক্ষ যে পানি সরবরাহ করে আসছে তা মাত্রাতিরিক্ত আয়রনযুক্ত। বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানি দূরের কথা, সাপ্লাই পানিতে কাপড়-চোপড় ধুলে হলুদ হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন রোগবালাইয়েও আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই।
পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) বিএম কামাল আহমেদ জানান, ১৯৯০ সালে যশোর শহরে আয়রনমুক্ত ও সুপেয় পানি সরবরাহের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ৩টি ওয়াটার আয়রন ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণ করা হয়। ফাইভ ডিস্ট্রিক ওয়াটার প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি ট্রিটমেন্ট প্লান্টে ব্যয় হয় এক কোটি ২৫ লাখ টাকা। এ হিসেবে ৩টি ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। দায়িত্বশীল এই কর্মকর্তার দাবি, যশোর পৌরসভার পানিতে তেমন আয়রন নেই। তাছাড়া ট্রিটমেন্ট প্লান্ট পরিচালনা করা বেশ ব্যয়বহুল। যে কারণে গভীর নলকূপ থেকে পানি তুলে সরাসরি সাপ্লাই লাইনের মাধ্যমে গ্রাহকদের মধ্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। পৌর কর্তৃপক্ষ ১৫ হাজার গ্রাহকের মধ্যে পানি সরবরাহ করছে বলে জানান এই প্রকৌশলী।
পৌরসভার অপর একটি সূত্রের দাবি- কয়েক বছর আগে পানির গ্রাহক ছিল ১৯ হাজারের কিছু বেশি। পানির মান ভাল না হওয়ায় অনেকেই স্বেচ্ছায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন। বিল বকেয়ার কারণেও কিছু সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে পৌর কর্তৃপক্ষ।
শহরের শংকরপুর গোলপাতা এলাকার বাসিন্দা গোলাম মোস্তফার অভিযোগ, "পৌরসভার সাপ্লাই পানিতে ময়লা আসে। মাঝেমধ্যে ট্যাপ থেকে হলুদ ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি পড়ে। প্রতি সপ্তাহে ট্যাংক পরিষ্কার করতে একটি ভিকসল কিনতে হচ্ছে। তাও ট্যাংক পরিষ্কার রাখা যাচ্ছে না। দুয়েক মাস পরপর মিস্ত্রি ডেকে বাড়ির পানির পাইপ পরিষ্কার করতে চলে যায় পাঁচশ টাকা। পাইপ পরিষ্কার করলে যা বের হয়, তা দেখলে যে কেউ বলবেন গোবরের গোলা।"
বেজপাড়ার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, "মাত্রাতিরিক্ত আয়রনের কারণে কাপড়-চোপড় হলুদ হয়ে যাচ্ছে। কলস ও বোতলে পানি রাখলে দু'একদিনের মধ্যে কালচে রঙ ধারণ করছে। এতে বুঝা যায় প্রচুর আয়রন আসছে।"
তিনি বলেন, "পৌরসভার সাপ্লাই পানি খাওয়া তো দূরের কথা, থালা-বাসনও ধোয়া যায় না। যে কারণে সাপ্লাই পানির ব্যবহার বন্ধ করেছি। এখন টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করছি।"
তাহলে সংযোগ রেখে লাভ কী এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "চাইলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যায় না। আইনের মারপ্যাঁচে আটকে আছি।"
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এক প্রকৌশলী জানান, ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে একেক জায়গায় আয়রনের মাত্রা একেক রকম হয়। তিনি বলেন, "যতদূর জানি যশোর পৌরসভার পানিতে এক থেকে তিন পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) আয়রন রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ৯০ সালের দিকে ৩টি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণ করা হয়। যার একটি সিটি কলেজপাড়ায়, একটি পালবাড়ি এলাকায় এবং অপরটি চাঁচড়া এলাকায়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এসব ট্রিটমেন্ট প্লান্ট একদিনও ব্যবহার করা হয়নি।"
সরেজমিনে দেখা যায়, পৌনে ৪ কোটি টাকায় নির্মিত ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তিনটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। স্থানীয়রা জানান, রক্ষণাবেক্ষণে উদাসীন পৌর কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৩২ বছর পড়ে থেকে এসব নষ্ট হয়ে গেছে বলেও মনে করেন তারা। তারা আরও বলেন, এর থেকেই বোঝা যায় পৌর কর্তৃপক্ষ নাগরিক সুবিধা রক্ষায় চরম উদাসীন।
সিটি কলেজপাড়ার বাসিন্দা সাব্বির হোসেন বলেন, "মার্চ-এপ্রিলে টিউবওয়েলে কম পানি ওঠে। কিছু টিউবওয়েলে পানি ওঠেই না। ওই সময় বাধ্য হয়ে পৌরসভার সাপ্লাই পানি ব্যবহার করতে হয়। সাপ্লাই পানি দিয়ে গরুর গোসল করাই, কিন্তু সাদা রংয়ের গরুর পশম হলদে হয়ে গেছে।"
জানা যায়, যশোর শহরে ৫ লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করেন। কম সংখ্যক মানুষ নিরাপদ পানি ব্যবহার করতে পারেন। বস্তিবাসী ও সীমিত আয়ের বিপুল সংখ্যক মানুষের ভরসা একমাত্র সাপ্লাই পানি। কিন্তু পৌর কর্তৃপক্ষ সিংহভাগ মানুষের ক্ষতির দিকগুলো বিবেচনা করে না। তারা কোনো রকম ট্রিটমেন্ট ছাড়াই আয়রনযুক্ত পানি সরবরাহ করছে।
এ বিষয়ে জানতে পৌরসভার মেয়র হায়দার গনী খান পলাশের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
তবে প্যানেল মেয়র রোকেয়া পারভিন ডলি বলেন, "কী কারণে ওয়াটার আয়রন ট্রিটমেন্ট প্লান্টগুলো বন্ধ রয়েছে তা খোঁজ না নিয়ে বলতে পারবনা।"