গবাদিপশুর সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা তথৈবচ
গত এক দশকে বাংলাদেশের গবাদিপশুর সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি বৃদ্ধি পেয়ে ৪৩.২৫ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। এ সংখ্যা দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে একদিকে জাতীয় প্রোটিন সরবাহ চেইন শক্তিশালী হয়েছে, অন্যদিকে গ্রামীণ বাংলাদেশে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। ফলে বদলে গেছে দেশের ফসল চাষ-প্রধান কৃষি খাতের দৃশ্যপট।
কিন্তু এই পরিবর্তনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পেশাদার পশুচিকিৎসকের তীব্র ঘাটতি। এতে গবাদিপশু পালন টেকসই খাত হতে পারছে না এবং শেষ পর্যন্ত ঝুঁকিতে পড়ে গেছে পুরো প্রোটিন সরবরাহ চেইন।
বিগত কয়েক বছরে পশুপালন ব্যাপক বাড়লেও বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিলের তথ্যানুসারে দেশে এখন বৈধ সনদপ্রাপ্ত পশুচিকিৎসক রয়েছেন ৮ হাজার ২৫ জন।
অথচ বাংলাদেশের ভেটেরিনারি ওষুধের বাজারের আকার এখন ৩ হাজার কোটি টাকা। এ বাজারে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৮-১০ শতাংশ। এতে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে: এসব ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন কারা?
এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য নওগাঁ সদর উপর জেলার ভীমপুর গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফার কথা ধরা যাক। এই ক্ষুদ্র কৃষক ফসল ফলানোর পাশাপাশি ৫-৬টি গরু পালেন।
গত বছর গোলাম মোস্তফার ষাঁড় গরুর জ্বরে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য ডাকা হয় স্থানীয় পশু চিকিৎসক সিরাজুল ইসলামকে। সিরাজুল গরুটিকে একটি ইনজেকশন দেন। ইনজেকশন দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই গরুটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে দেড় লাখ টাকা মূল্যের ষাঁড়টি জবাই করে স্থানীয় বাজারে মাংস বিক্রি করতে বাধ্য হন গোলাম মোস্তফা।
সিরাজুল নিবন্ধিত পশুচিকিৎসক নন। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে পশুচিকিৎসকের তীব্র সংকটের সুবাদে তিনি পূর্ণকালীন পল্লি পশুচিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন। পশু চিকিৎসায় পর্যাপ্ত পড়াশোনা, প্রশিক্ষণ না থাকায় সনদবিহীন গ্রাম্য পশুচিকিৎসকদের কারণে সারাদেশেই গোলাম মোস্তফার মতো কৃষকরা বিপাকে পড়ছেন। পর্যাপ্ত পশুচিকিৎসকের অভাবে কৃষক, খামারিরা বিপদে পড়লেও বারবার এসব গ্রাম্য চিকিৎসকদের কাছেই যেতে বাধ্য হন। কারণ উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের চিকিৎসক ছোটখাটো রোগে সেবা দিতে যান না। বড় রোগ হলে বেশিরভাগ সময়ই প্রাণীকে নিয়ে যেত হয় চিকিৎসাকেন্দ্রে এবং সরকারি চিকিৎসককে একটা বড় অঙ্কের ফি দিতে হয়।
অবৈধ, তাতে কী?
নওগাঁ জেলায় ৯৯টি ইউনিয়ন রয়েছে। এসব ইউনিয়নে প্রায় ২১ লাখ গবাদিপশু আছে। কিন্তু এর বিপরীতে পুরো জেলায় পশুচিকিৎসক মাত্র ১৫ জন।
চিকিৎসকরা বলছেন, তাদের অফিসিয়াল কাজ-কর্ম করতে হয়। তারা খামারে খামারে যেতে পারেন না। তাই প্রাথমিক চিকিৎসার কাজগুলো সাধারণত গ্রাম্য চিকিৎসকরাই করেন। তাদের সনদ নেই, তবে কিছু মৌলিক প্রশিক্ষণ আছে। বড় কোনো সমস্যায় প্রাণীকে পশু হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসা পাওয়া যায়।
কিন্তু কর্তৃপক্ষ বলছে, নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে বৈধ উপায়ে বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিলের সনদ ছাড়া এ ধরনের চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা পুরোপুরি 'অবৈধ'।
নওগাঁ জেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. মহির উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নিবন্ধনবিহীন "পল্লি চিকিৎসকদের" চিকিৎসা দেওয়া সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদেরও লোকবল নেই পর্যাপ্ত সেবা দেওয়ার। এই সুযোগটাই তারা নিচ্ছেন।'
নওগাঁর মতো একই অবস্থা বগুড়ার শেরপুর উপজেলারও। শেরপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রায়হান ইসলাম বলেন, এই উপজেলায় অন্তত আড়াই লাখ গবাদিপশু রয়েছে। এর বিপরীতে মাত্র একটি প্রাণিসম্পদ অফিস। এর বাইরে অন্তত দেড় শতাধিক হাতুড়ে পল্লি চিকিৎসক উপজেলায় সেবা দিচ্ছেন।
একই অবস্থা বগুড়া, খুলনা, রাজশাহী, লক্ষ্মীপুর, দিনাজপুর, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলার।
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার মৌগাছি ইউনিয়নের গ্রাম্য পশু চিকিৎসক খোরশেদ আলম তিন বছর ধরে পশুর চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। তার কোনো চিকিৎসা প্রশিক্ষণ বা সনদ নেই, কিন্তু দিনে গড়ে চারজন গ্রাহককে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
বগুড়ার শিবগঞ্জের রহবল এলাকার 'পশু চিকিৎসক' হিসেবে পরিচিত মজনু প্রামাণিক। ২৩ বছর ধরে তিনি চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে 'কবিরাজি' চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। বাকি সময়টাও তিনি এই সেবা দিয়ে যেতে চান।
খামার থেকে খাবার টেবিলে—গোটা প্রোটিন চেইনকে দূষিত করা
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, গবাদিপশুর রোগের চিকিৎসার জন্য স্থানীয় হাতুড়ে চিকিৎসক এবং ফার্মাসিস্টদের দেওয়া ওষুধ, বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিকের নির্বিচার ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
তারা বলেন, ওষুধগুলো নানা উপায়ে অনায়াসে খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করতে পারে।
কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধান ও স্থানীয় পর্যায়ে পশুচিকিৎসকের অভাবের কারণে গ্রামীণ কৃষকরা প্রায়ই অ্যান্টিবায়োটিকের দিকে ঝুঁকে পড়েন। কারণ এগুলো ফার্মেসিতে সহজলভ্য এবং দ্রুত ফল দেয়।
অ্যান্টিবায়োটিকের একটা 'উইথড্রয়াল পিরিয়ড' আছে। গবাদিপশুর দুধ যাতে দূষিত না হয়, সেজন্য এই সময়ের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যায় না।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই সময়ের পরেও দুধে অ্যান্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া যেতে পারে। দুগ্ধজাত দ্রব্যে গ্রহণযোগ্য মাত্রার ওপরে অ্যান্টিবায়োটিকের উচ্চ ঘনত্বের উপস্থিতিতে মানুষের দেহ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হতে পারে। এতে ভোক্তারা ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের আক্রান্ত হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমানের মতে, মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া বা গরু মোটাতাজাকরণের জন্য এটি ব্যবহার করা হলে তা গবাদিপশু ও মানুষ উভয়ের ওপরই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
তিনি একটি ভেটেরিনারি ব্যথানাশক ওষুধের কথা জানান যার কারণে দেশ থেকে শকুন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
প্রদাহ-রোধী ও ব্যথানাশক ট্যাবলেট ডাইক্লোফেনাক ২০ শতকের শেষের দিকে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশে অসুস্থ গবাদিপশুর চিকিৎসার জন্য চালু করা হয়।
কিন্তু যখন গবাদিপশুর মৃতদেহ খাওয়ার পর শকুন কিডনি রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় শকুনের সংখ্যা বিস্ময়করভাবে ৯৯.৯ শতাংশ কমে যায়।
গবাদিপশুর সংখ্যা বাড়ছে, চিকিৎসক অপ্রতুল
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে দেশে ২ কোটি ৪৭ লাখ গরু, ১৫ লাখ মহিষ, ৩৭ লাখ ভেড়া, ২ কোটি ৬৭ লাখ ছাগল, ৩১ কোটি ১৮ লাখ মুরগি এবং ৬ কোটি ৩৮ লাখ হাঁস রয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে গত এক দশকে মাংস উৎপাদন তিনগুণেরও বেশি এবং ডিমের উৎপাদন প্রায় তিনগুণ হয়েছে।
এছাড়া প্রতিনিয়তই বাড়ছে বাণিজ্যিক খামারির সংখ্যা।
কিন্তু এত বড় একটি খাতের জন্য চিকিৎসকের পরিমাণটা খুবই অপ্রতুল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গড়ে প্রতি নয়টি ইউনিয়নের জন্য একজন পশুচিকিৎসক রয়েছেন।
প্রাণিসম্পদ অধিপ্তরের প্রাণী স্বাস্থ্য শাখার উপপরিচালক ড. মো. নাজমুল হক টিবিএসকে বলেন, 'এখন যে পরিমাণ ভেটেরিনারি ডাক্তার রয়েছে সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এটাকে কয়েকগুণ বাড়াতে পারলে সেবার পরিধিও বাড়ানো সম্ভব হবে।'
অপুষ্টি, বেকারত্ব, নারীর ক্ষমতায়ন ও কৃষি জমির উর্বরতা বৃদ্ধির মতো সমস্যা মোকাবিলা করার পাশাপাশি দেশের মেধা বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে প্রাণিসম্পদ শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১.৪৭ শতাংশ, আর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৩.৪৭ শতাংশ। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ সরাসরি প্রাণিসম্পদ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত।
বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিলের সভাপতি ড. মো. মনজুর কাদির টিবিএসকে বলেন, 'কাউন্সিলের সনদ ছাড়া কেউ পশুর চিকিৎসা সেবা দিতে পারে না। এর জন্য আমরা এখন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা শুরু করেছি।'
তিনি বলেন, 'পর্যাপ্ত বৈধ চিকিৎসকের অভাবেই গ্রামে-গঞ্জে খামারের ট্রেনিংপ্রাপ্তরা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে। এই সেবা নিশ্চিতের জন্য সরকারের চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই।'
কৃষি খাত সামগ্রিকভাবে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সহায়তা করছে।