ক্যান্সার চিকিৎসায় প্রতিবন্ধকতা: সরঞ্জাম স্বল্পতায় থেরাপি পেতে দীর্ঘ অপেক্ষা রোগীদের
স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত গেন্ডারিয়ার ধুপখোলার বাসিন্দা নাহার বেগমের (৫১) সার্জারি করা হয়েছে এক বছর আগে। তারপর ২১ দিন পর পর ৮টি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এরপরে হঠাৎই বাধার সম্মুখীন হয় তার ক্যান্সারের চিকিৎসা।
কেমোথেরাপির পর দ্রুত রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হলেও সিরিয়াল পেতে প্রায় ৭ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। গতমাসে দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল- ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ক্যান্সার রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটালে (এনআইসিআরএইচ) রেডিওথেরাপির সিরিয়াল পেয়েছেন তিনি। ১৪টি রেডিওথেরাপি নিয়েছেন ৬ হাজার ২০০ টাকায়। আরো ৪টি রেডিওথেরাপি দিতে হবে তাকে।
এরপরেও নাহার বেগম নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন, কারণ ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালে প্রতিদিন শত শত ক্যান্সার রোগী রেডিওথেরাপির জন্য সিরিয়ালের অপেক্ষায় থাকেন।
গেল সপ্তাহে ক্যান্সারের চিকিৎসায় দেশের শীর্ষ এই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের রেডিওথেরাপির ৬টি মেশিনের মধ্যে ৫টিই নষ্ট। ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্যান্য যন্ত্রপাতির মধ্যে রেডিওথেরাপির চারটি লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিনের মাত্র একটি সচল; একটি নষ্ট হয়েছে সম্প্রতি। বাকি দুটির আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। দুটি কোবাল্ট-৬০ বাতিল করা হয়েছে। একটি ব্র্যাকিথেরাপি দেওয়ার জন্য যন্ত্র চালু আছে।
ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মীরা জানান, দুই-তিন বছর যাবত একটি একটি করে যন্ত্রপাতি নষ্ট হতে হতে এখন এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এখন একটি রেডিওথেরাপি মেশিনে দৈনিক ১০৫ থেকে ১১০ জনকে থেরাপি দেওয়া হয়।
এখানে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায় রেডিওথেরাপির কোর্স সম্পূর্ণ করা হয়, যা প্রাইভেট হাসপাতালে শেষ করতে প্রায় ২ লাখ টাকা লাগে। সাধারণত জরায়ুর ক্যান্সারে ২৫টি রেডিওথেরাপি, স্তন ক্যান্সারে ১৫টি এবং মস্তিষষ্কের ক্যান্সরের জন্য প্রয়োজন হয় ২৫টি রেডিওথেরাপির।
এই অবস্থা শুধু ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটেই নয়, ক্যান্সারের চিকিৎসা দেওয়া আরও ৯টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে ৫টিতেই রেডিওথেরাপি মেশিন ঠিকভাবে কাজ করে না। সবখানে দেওয়া হয় না কেমোথেরাপি। ডায়াগনোসিস নিয়েও রয়েছে রোগীদের অসন্তুষ্টি, সে কারণে ক্যান্সার চিকিৎসায় বিদেশে যেতে বাধ্য হন অধিকাংশ রোগী।
সূত্র জানায়, ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের আউটডোরে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী আসে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসপাতালে যা হয়, সেখানে করেন বা বাইরে থেকে করে ক্যান্সার হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডকে রিপোর্ট দেন রোগীরা। রিপোর্ট দেখে মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয় সার্জারি হবে নাকি রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি দেওয়া হবে নাকি সবগুলো করা হবে।
সার্জারি বা কেমোথেরাপি হলে একটি দিন নির্ধারণ করে দেয় বোর্ড। কিন্তু রেডিওথেরাপি হলেই বোর্ড জানিয়ে দেয় মেশিন স্বল্পতার কারণে এখানে এখন চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা, সম্ভাব্য তারিখ দেওয়া হয় ৬ থেকে ৭ মাস পরের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেডিয়েশন অনকোলজি ডিপার্টমেন্টের এক টেকনোলজিস্ট বলেন, রেডিয়েশন কোন জায়গায় দেওয়া হবে, তা খুঁজে বের করার জন্য যে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় তাও অকেজো হয়ে গেছে। তাই অ্যানাটমিক্যাল পজিশন থেকে এক্সরে বা সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট দেখে রেডিয়েশন দেওয়া হয় এখানে।
তবে এতে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের বাইরে দেহের ভালো কোষগুলোতেও রেডিয়েশন দেওয়ার ঝুঁকি থেকে যায় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "একজন ক্যান্সার রোগীর জীবনে কখনো না কখনো রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয়। আমাদের একটি মেশিন চালু আছে, ঢাকা মেডিকেলে একটি এবং বগুড়ায় চালু আছে একটি মেশিন। এখন চিকিৎসার প্রায় সিংহভাগই প্রাইভেট হাসপাতাল কেন্দ্রিক। যারা খরচ বহন করতে পারছেন, তারা বিদেশে বা প্রাইভেট হাসপাতালে যাচ্ছেন। যারা পারছে না, তারা আসছেন এখানে। আজ যে রোগী এখানে এসেছেন, তিনি ৬ মাস পর হয়তো সিরিয়াল পাবেন।"
তিনি আরো বলেন, ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগীই আসেন লাস্ট স্টেজে। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা কেমোথেরাপি।
ক্রমবর্ধমান রোগীর বিপরীতে সীমিত সক্ষমতা
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির ডেটা দেখায়, দেশে আনুমানিক ক্যান্সার রোগী আছে ১৩ থেকে ১৫ লাখ। প্রতি বছর ২ লাখের বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয়। এছাড়া, বছরে মারা যায় প্রায় দেড় লাখ ক্যান্সার রোগী।
ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি ডাঃ গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক টিবিএসকে বলেন, "আজ যে রোগী হাসপাতালে যাবেন, তাকে এক বছর পর ডেট দিলে রোগ তো ছড়াবেই। সরকারি হাসপাতালে মেশিন নষ্ট থাকার কারণে রোগীরা বাধ্য হয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে যান। হতাশ হয়ে অনেক রোগী বিদেশে যান। এছাড়া, ডায়াগনোসিস সমস্যার কারণেও রোগীরা বিদেশে যান।"
তথ্য দেখায়, প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান প্রায় ৭ লাখ বাংলাদেশি। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য বছরে কতজন রোগী বিদেশে যান, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের বেশিরভাগই ক্যান্সারের রোগী।
মেডিক্যাল ট্যুরিজম গন্তব্যের তালিকায় ভারত রয়েছে শীর্ষে, এরপরে রয়েছে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো অন্যান্য দেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ অর্থবছরে বিদেশে চিকিৎসার জন্য ২.২ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন বাংলাদেশিরা, ২০২০ অর্থবছরে ১.৬ মিলিয়ন, ২০২১ অর্থবছরেও ১.৬ মিলিয়ন এবং চলতি ২০২৩ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খরচ করেছেন ০.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসার মান উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য হলেও দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য প্রয়োজন একটি করে ক্যান্সার সেন্টার। যে সেন্টারে থাকবে একটি লিনিয়ার, কোবাল্ট, ব্র্যাকিথেরাপি মেশিন, একটি কেমোথেরাপি ডিপার্টমেন্ট ও সার্জারি ডিপার্টমেন্ট।
সেই হিসাবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিবেচনায় এখন দেশে প্রায় ২০০ সেন্টারের প্রয়োজন।
'সংকট নিরসনের চলছে চেষ্টা'
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ নিজামুল হক হাসপাতালের যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, "আমি দুই মাস আগে এ দায়িত্বে এসেছি। এখন সব সমস্যা সমাধানে কাজ করছি। এখানে রেডিওথেরাপি দিতে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়। আমাদের একটি রেডিওথেরাপি মেশিন সচল আছে। বাকি চারটি মেশিন সরকার ইতোমধ্যে বাতিল ঘোষণা করেছে, মানে এগুলো অকার্যকর।"
একটি মেশিন মেরামত যোগ্য উল্লেখ করে তিনি জানান, সেটি দ্রুতই মেরামত করা হবে। তবে মেরামতে দেরি হচ্ছে, কারণ কোম্পানি পরিবর্তন হয়ে গেছে।
অতিদ্রুত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আরেকটি ব্র্যাকি মেশিন পাওয়ার কথা রয়েছে বলেও জানান ডাঃ নিজামুল হক।
"সিএমএসিডির মাধ্যমে একটি লিনিয়ার মেশিন পাবো, সেটির টেন্ডার হয়ে গেছে। এছাড়া, আমাদের নিজস্ব বাজেটে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে একটি লিনিয়াক মেশিনের টেন্ডার করবো," যোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক ডাঃ নিজামুল হক আরও বলেন, "আমাদের ৪টি অপারেশন থিয়েটর ছিল, শিগগিরই আরো ৪টি অপারেশন থিয়েটর চালু করা হবে। আমাদের ৩০০ বেডের হাসপাতাল ৫০০ বেড করা হলেও জনবল বাড়েনি। সরকার ৮টি বিভাগে ৮টি ক্যান্সার সেন্টার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। সেগুলো হলে আমাদের চাপ কমবে, বিদেশ যাওয়ার হারও কমবে।"
আজ ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো, 'ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ', বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, 'আসুন, ক্যান্সার সেবায় বৈষম্য দূর করি'।