৮০% অগ্রগতি দেশের প্রথম পর্যটন রেল প্রকল্পে, এ বছরই ট্রেন চলবে কক্সবাজারে
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বহুল প্রতীক্ষিত পর্যটন রেললাইনের কাজ নির্ধারিত সময়সীমা, ২০২৪ সালের জুনের আগেই শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। নির্মাণাধীন ১০০ কিলোমিটারের এই রেলপথের ৬৫ কিলোমিটার এখন দৃশ্যমান।
রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এ পর্যন্ত (জানুয়ারি) প্রকল্পের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। মোট ১০০ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে ৬৫ কিলোমিটার দৃশ্যমান। মোট ৯টি স্টেশনের মধ্যে দুটি পুরোপুরি সম্পন্ন, ৫টির অবকাঠামো কাজ সম্পন্নের পর ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে এবং বাকি দুটির অবকাঠামোর কাজ এখনও চলছে।"
রেল পরিষেবাটির জন্য জনবল কাঠামো অনুমোদনের নথি ২০২১ সালের জুনে রেলপথ অধিদপ্তরের মাধ্যমে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এরপর ২০২২ সালের জুনে তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক বলেন, "আমরা এখন জনবল নিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছি।"
এর আগে, রেলমন্ত্রী মোঃ নুরুল ইসলাম সুজন বলেছিলেন, নির্ধারিত সময়সীমার প্রায় একবছর আগে এ বছরের জুন-জুলাইয়ের মধ্যেই প্রকল্পটি শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
"যেকোনো কারণে জুনে কাজ শেষ না হলে আরও দুয়েক মাস লাগতে পারে। তারপরও আমরা এ বছরের মধ্যেই ট্রেনে চড়ে কক্সবাজার যেতে পারব," বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে এ কথা বলেন তিনি।
১০০ কিলোমিটারের এই রেললাইনের মাধ্যমে দেশের ৪৫তম জেলা হিসেবে রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হতেও যাচ্ছে কক্সবাজার। প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে ঢাকা থেকে কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার, উভয় রুটে ১০টি করে ট্রেন ডুয়েল গেজ ট্র্যাকে চলবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা থেকে মাত্র সাড়ে ৭ ঘন্টায় এবং চট্টগ্রাম থেকে আড়াই ঘন্টায় ট্রেন পৌঁছাবে কক্সবাজারে। প্রতিদিন এক লাখেরও বেশি মানুষ যাতায়াত করতে পারবেন এই রুটে। প্রাথমিক হিসাবে, ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেনে মানভেদে প্রতি টিকেটের দাম ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকা এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পড়বে।
এছাড়া, মাছ, শুঁটকি, লবণ ও অন্যান্য পণ্য কক্সবাজার থেকে দেশের অন্যান্য স্থানে পরিবহনের জন্য থাকবে বিশেষ রেফ্রিজারেটেড ওয়াগন সার্ভিস।
দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের অন্তত আটটি উপজেলার যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হওয়ার পাশাপাশি এই রেলপথ এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করবে বলেও অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মৎস, লবণ, শুটকি, সবজিসহ নানান শিল্পের জন্য সহায়ক হবে এই রেল যোগাযোগ। যে নয়টি স্টেশন রয়েছে, সেসব উপজেলাতেও কর্মচঞ্চলতা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে।"
২০১০ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন পেলেও এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৮ সাল থেকে। প্রকল্পের জন্য সংশোধিত আনুমানিক ব্যয় প্রায় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৫ কোটি টাকা; এরমধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং বাকি খরচ বহন করছে বাংলাদেশ সরকার।
প্রকল্পের আওতায় ১০০ কিলোমিটার রেললাইন ছাড়াও কক্সবাজার সদর, রামু, ইসলামাবাদ, ডুলাহাজরা, চকরিয়া, হারবাং, লোহাগড়া, সাতকানিয়া ও দোহাজারীতে মোট ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে প্রকল্পটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ কক্সবাজারের আইকনিক ঝিনুক আকৃতির স্টেশনটি।
দৃশ্যমান কক্সবাজারের শতভাগ পর্যটকবান্ধব আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন
সমুদ্রসৈকত থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ঝিলংজা ইউনিয়নের প্রায় ২৯ একর জায়গাজুড়ে ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টিনন্দন স্টেশনটি এখন দৃশ্যমান। ঝিনুকের আদলে নির্মিত হয়েছে এই স্টেশন।
এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয় তল বিশিষ্ট স্টেশনটির সম্পূর্ণ ফ্লোর এরিয়া ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুট। রয়েছে পর্যটকদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা।
গত সোমবার (৩০ জানুয়ারি) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কক্সবাজারে ছয় তলা ভবনটিতে এখন চলছে সৌন্দর্যবর্ধন, গ্লাস ফিটিং, ফায়ার ফাইটিং, স্যানিটারি ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি স্থাপনসহ শেষ মুহূর্তের কাজ।
এ পর্যন্ত স্টেশনটির নির্মাণকাজের প্রায় ৮৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
আইকনিক এই স্টেশনটি নির্মাণের সময় চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশিসহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী নিয়োজিত ছিলেন। পর্যটকরা যেন কক্সবাজারে দিনে এসে ঘুরে আবার ফিরে যেতে পারেন, সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, কক্সবাজারে পর্যটকদের অর্ধেকই আসেন একদিনের জন্য। এ সময় তারা নিজেদের মালপত্র রাখার নিরাপদ জায়গা পান না। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে স্টেশনে রাখা হচ্ছে লাগেজ ও লকার সিস্টেম।
এছাড়া থাকছে আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা; থাকছে সাধারণ ও ভিআইপিদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ড্রপ এরিয়া; বাস, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস এবং থ্রি হুইলারের জন্য আলাদা পার্কিং এরিয়া; থাকছে সুপারমার্কেট, ফার্মেসি, এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথ, ফরেক্স সেবা সার্ভিস ছাড়াও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবা কেন্দ্র।