রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল: টাকা নিয়েও যাত্রীদের সেবা দিচ্ছে না ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিট। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের ৫ নম্বর প্লাটফর্মে এসে পৌঁছায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের চলাচলকারী ট্রেন সোনার বাংলা এক্সপ্রেস। একটু পরে ওই ট্রেনের এসি স্লিপার কোচ থেকে এক যাত্রীকে টানাটানি করে কয়েকটি লাগেজ নামাতে দেখা যায়। লাগেজ নামাতে গিয়ে স্ত্রী ও ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে তাকে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়তে হয়। অথচ বাংলাদেশ রেলওয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত অনবোর্ড সেবা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ওই কোচে স্টুয়ার্ড নিয়োজিত থাকলেও তাকে এ সময় যাত্রীর সহায়তায় এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি।
অবশ্য ঠিক আধ ঘণ্টা আগে একই স্টেশনে দেখা গিয়েছিলো ভিন্ন চিত্র। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছেড়ে যাওয়ার আগে ওই্ ট্রেনের কয়েকজন স্টুয়ার্ডকে প্লাটফর্ম থেকে ডেকে ডেকে টিকিটবিহীন যাত্রীদের উৎকোচের বিনিময়ে ট্রেনে উঠাতে দেখা যায়; অথচ রেলওয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করেছে রেলযাত্রায় ট্রেনে টিকিটবিহীন যাত্রীর ভ্রমণ ঠেকানোসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানের জন্য।
শুধু বৃহস্পতিবার নয়, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেনের প্রতিদিনের দৃশ্য এটি। অথচ পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচলকারী ৯টি ট্রেনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃক নিয়োগকৃত অনবোর্ড সেবা পরিচালনাকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতি মাসে দেওয়া হচ্ছে ৩৭ লাখ ৬৭ হাজার ৪০০ টাকা।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, যাত্রী সেবার জন্য প্রতিটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ৪ লাখ ১৮ হাজার ৬০০ টাকা করে পরিশোধ করছে রেলওয়ে। কিন্তু টাকা দেওয়া হলেও সেবা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেয়নি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও রেল কর্মকর্তারা।
বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী মহানগর এক্সপ্রেসের ২২২৭ নম্বর কোচের সামনে দাঁড়ানো একজন স্টুয়ার্ড প্লাটফর্মে দাঁড়ানো যাত্রীদের টিকিট যাচাই করছিলেন। এসময় বেশ কয়েকজন যাত্রীর টিকিট না থাকলেও উৎকোচের বিনিময়ে তাদের কোচে তুলতে দেখা যায়।
তাদের একজন কুমিল্লার বাসিন্দা নুরুল আলম। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, টিকিট ছাড়াই নাঙ্গলকোট স্টেশন পর্যন্ত ২০০ টাকায় চুক্তিতে ট্রেনে উঠেছেন তিনি।
বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রতিবেদক সেই স্টুয়ার্ডের সঙ্গে কথা বলেন। তখন ওই স্টুয়ার্ড বিষয়টি স্বীকার করেন এবং প্রতিবেদককে জানান, ওই যাত্রী অবৈধভাবে ট্রেনে চড়লেও তার যেন আর কোনো সমস্যা না হয় বিষয়টি তিনি দেখভাল করবেন। ওই স্টুয়ার্ড প্রতিবেদককে বলছিলেন, 'ওসব আমাদের ব্যবস্থা করা আছে, আপনি বসুন, টিটি আসলে আমি তাকে বোঝাবো।"
সেদিন মহানগর এক্সপ্রেসের প্রায় সবগুলো কোচ সরেজমিনে ঘুরে কোনোটার টয়লেটেই সাবান পাওয়া যায়নি, বেশ কয়েকটি টয়লেট ছিলো অপরিচ্ছন্ন। এছাড়া যাত্রা শুরুর আগে ট্রেনে মশা, পোকামাকড় ও দুর্গন্ধ দূর করতে এরোসল ও এয়ার ফ্রেশনার ব্যবহারের শর্ত থাকলেও তা করা হয়নি।
একই দিন দুপুরে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছানো সোনার বাংলা এক্সপ্রেসের যাত্রী ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা রকিবুল হাসান। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সোনার বাংলাকে দেশের সবচেয়ে ভালো ট্রেন সার্ভিস মনে করা হয়। কিন্তু যাত্রীদের জন্য এর সার্ভিস হাইজেনিক নয়। বিশেষ করে বাথরুমের পরিস্থিতি খুব খারাপ, বেশ অপরিষ্কার ছিলো রুমের ভেতরও। এছাড়া অনেক সময় চাইলেইও স্টুয়ার্ডদের পাওয়া যায় না।'
ওই ট্রেনের আরেক যাত্রী রোখসানা বেগম বলেন, 'ট্রেনে অনেক যাত্রী ভ্রমণের সময় অসুস্থ বোধ করেন, বিশেষ করে মহিলারা। কিন্তু ট্রেনে তেমন কোনো ফাস্ট এইড সেবা না থাকায় যাত্রীরা ট্রেনে বিপদে পড়েন।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনার বাংলা এক্সপ্রেসের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান মেসার্স হাবিব বাণিজ্য বিতানের প্রোপাইটার মো. মামুন হোসনও ট্রেনে যাত্রীরা ঠিকভাবে সেবা পাচ্ছেন না বলে স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, 'সবসময় শতভাগ সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। বিশেষ করে গাড়ি ছাড়ার মুহূর্তে কিছু অনাহুত যাত্রী ট্রেনে চড়ে বসেন। এ অভিযোগে বিভিন্ন সময় আমরা গতবছর ৫ জন স্টুয়ার্ডকে বহিষ্কার করেছি।'
রেলের সঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোচ প্রতি ১ জন স্টুয়ার্ড, ট্রেনে দুইজন সুইপার ও দুইজন সুপারভাইজার নিয়োগ দেবে। যারা টিকিটবিহীন যাত্রী ঠেকাবে এবং যাত্রীদের সেবা নিশ্চিত করবে।
ট্রেনে সংবাদপত্র সরবরাহের খবর জানেন না যাত্রীরা
রেলওয়ের সঙ্গে অনবোর্ড সেবা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তির অন্যতম শর্ত হলো, ট্রেনের প্রতিটি কোচে একটি পত্রিকা থাকবে, যা যাত্রীরা পাঠের জন্য পাবেন। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী প্রায় সবগুলো ট্রেনের যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, যাত্রীরা জানেনই না ট্রেনে পত্রিকা পাঠের সুবিধা রয়েছে।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন ব্যবসায়িক কাজে প্রতিমাসেই ট্রেনে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত করেন। তিনি বলেন, 'আমার গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতায় কখনোই রেলে পত্রিকা সরবরাহ করতে দেখিনি।
রেলে যাত্রীদের সেবা নিয়ে কথা বলার জন্য সুবর্ণা এক্সপ্রেসের অনবোর্ড সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এসএ কর্পোরেশনের প্রোপাইটার শো. শাহ আলম এবং মহানগর গোধূলী ও তূর্ণার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান স্বপ্নিল অ্যাসোসিয়েশনের প্রোপাইটার ইয়াসমিন আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের একাধিকবার চেষ্টা করেও সংযোগ স্থাপন করা যায় নি।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, যাত্রী পরিসেবায় ব্যত্যয় ঘটলে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে রেলওয়ে নূন্যতম ৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। বিনা বেতনে যাত্রী পরিবহনের প্রমাণ পাওয়া গেলে আদায়কৃত ভাড়ার দ্বিগুণ অর্থ জরিমানা ও প্রতিটি কোচে স্টুয়ার্ড দিতে ব্যর্থ হলে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্য টাকা থেকে সে হিসেবে অর্থ কর্তন করা হবে। কিন্তু একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর টেন্ডার পেয়ে ব্যবসা করলেও, সেবা ঘাটতির কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার রেকর্ড নেই রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চীফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার নাজমুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'যাত্রী সেবা নিশ্চিতে আমরা মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা করি। তবে প্রতিদিন প্রতিটি কোচে নজরদারি সম্ভব নয়'।